টাইফয়েড রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসা - টাইফয়েড মেরীর গল্প

যক্ষ্মা রোগ কিভাবে ছড়ায়প্রিয় পাঠক আপনি হয়তো টাইফয়েড রোগ যেভাবে ছড়ায়, টাইফয়েড রোগের লক্ষণ, টাইফয়েড মেরীর গল্প, টাইফয়েড এর প্রতিকার বা চিকিৎসা, টাইফয়েড জ্বর কেন হয়, টাইফয়েড এর প্রতিরোধ জানতে অনেক খুঁজাখুঁজি করছেন। তাই টাইফয়েড রোগ বা জ্বর সম্পর্কে জানতে মনোযোগ সহকারে পড়ুন।
টাইফয়েড রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসা
টাইফয়েড রোগের বাহক মূলত হচ্ছে মানুষ এবং এ সম্পর্কে বাস্তব নন্দিত একটি গল্প রয়েছে। আজকে আমরা টাইফয়েড মেরীর গল্প জানব।

ভূমিকা

টাইফয়েড মূলত একটি পানি বাহিত রোগ। উনিশ শতকে যুক্তরাষ্ট্রে হাজার হাজার মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয় এবং উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ মৃত‍্যুবরণও করে।
ধারণা করা হয়ে থাকে যে দূষিত পানি পান করে এবং আক্রান্ত ব‍্যক্তি বা জীবাণু বহনকারী মানুষের হাতের তৈরি বা রান্না করা খাবার খেয়ে এ রোগ হয়েছিল। টাইফয়েড রোগের চিকিৎসা তাড়াতাড়ি না হলে শরীরে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। চলুন শুরুতে জেনে নেই টাইফয়েড জ্বর কেন হয়।

টাইফয়েড জ্বর কেন হয়

টাইফয়েড জ্বর কেন হয় : টাইফয়েড রোগ এক প্রকার আন্ত্রিক জ্বর। এ টাইফয়েড জ্বরের কারণ স‍্যালমোনেলা টাইফি (Salmonella typhi) নামক এক প্রকার ব্যাকটেরিয়া। স‍্যালমোনেলা টাইফি ছাড়া এ ব‍্যাকটেরিয়ার অন‍্যান‍্য গ্রুপ রয়েছে যাদের কারণে প‍্যারা-টাইফয়েড জ্বরের সৃষ্টি হয়। এ সকল ব‍্যাকটেরিয়া হল -
  • স‍্যালমোনেলা প‍্যারাটাইফি-এ (Salmonella paratyphi-A)
  • স‍্যালমোনেলা প‍্যারাটাইফি-বি (Salmonella paratyphi-B)
  • স‍্যালমোনেলা প‍্যারাটাইফি-সি (Salmonella paratyphi-C)

টাইফয়েড রোগ যেভাবে ছড়ায়

টাইফয়েড রোগ যেভাবে ছড়ায় তা বর্ণনা করা হল -
  • পানির মাধ্যমে পানীয় জল দূষণের ফলে এ রোগ এপিডেমিক আকার ধারণ করতে পারে।
  • পানীয় দুধ এবং অন‍্যান‍্য দুগ্ধজাত দ্রব্য দূষিত হলে টাইফয়েড রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে। অন‍্যান‍্য খাদ্য সামগ্রী নারিকেল, শেলফিশ, শুষ্ক অথবা হিমায়িত ডিম প্রভৃতি স‍্যালমোনেলা ব‍্যাকটেরিয়া দ্বারা দূষণের ফলে রোগ ছড়িয়ে পড়ে।
  • আর্দ্র উষ্ণমন্ডলীয় অঞ্চল যেমন- বাংলাদেশের ঘনবসতিপূর্ণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে মাছির মাধ্যমেই মল দ্বারা খাদ্য দ্রব্য দূষণের ফলে বিস্তার লাভ করে।
  • দূষিত লিনেন বস্ত্র, বেডপ‍্যান এবং চায়ের কাপ রোগীর ব‍্যবহৃত বাসন পত্র প্রভৃতির সাহায্যে কখনো কখনো টাইফয়েড রোগ ছড়াতে পারে।
টাইফয়েড রোগ যেভাবে ছড়ায় তা আমরা জানলাম। টাইফয়েড রোগ ছড়ালে টাইফয়েড রোগের লক্ষণ গুলো দেখা দেয়। তো এখন আলোচনা করব টাইফয়েড রোগের লক্ষণ সম্পর্কে।

টাইফয়েড রোগের লক্ষণ

টাইফয়েড রোগের প্রধান লক্ষণ গুলো হল -
  • প্রথম দিকে শীত শীত ভাব ও পরে অবিরাম জ্বর।
  • মাথা ব্যথা ও অন্ত্র ফুলে যাওয়ায় পেটে প্রচণ্ড ব‍্যথা ও বমি হয়।
  • রোগীর ক্ষুধামন্দাসহ অস্থিরতা লক্ষ‍্য করা যায়।
  • রোগীর প্লীহা বড় হয় এবং সর্বাঙ্গে লাল গোলাপি বর্ণের ছোট ছোট ফুসকুঁড়ি দেখা দেয়।
  • রোগের দ্বিতীয় বা তৃতীয় সপ্তাহে রোগীর অন্ত্রে ঘা হয়, পাতলা পায়খানা শুরু হয় এবং পেটের ব্যথা আরও তীব্র হয়।
  • এ রোগ কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হয়।
  • কিছু কিছু ক্ষেত্রে আক্রান্ত ব‍্যক্তি টাইফয়েড রোগের লক্ষণ ছাড়াই রোগের ব‍্যাকটেরিয়া বহন করে এবং অন‍্যান‍্যদের মধ‍্যে এ রোগ ছড়ায়। তখন তারা বাহক হিসেবে চিহ্নিত হয়।
কোন বাক্তির টাইফয়েড রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেলে উক্ত-বাক্তিকে সকলের থেকে আলাদা রাখতে হবে। আর অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

টাইফয়েড এর প্রতিকার বা চিকিৎসা

টাইফয়েড এর প্রতিকার বা চিকিৎসা করার ক্ষেত্রে প্রধানত ক্লোরামফেনিকল এন্টিবায়োটিক ব‍্যবহার করা হয়ে থাকে। তবে জ্বর কমাতে প্রায় ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টা সময়ের প্রয়োজন। এই এন্টিবায়োটিক ব‍্যবহারের কিছু খারাপ দিক রয়েছে। যেমন -
  • এটি ব‍্যাকটেরিওস্ট‍্যাটিক অর্থাৎ ব‍্যাকটেরিয়া ধ্বংস না করে তার বৃদ্ধি রহিত করে।
  • বাহক অবস্থায় এ এন্টিবায়োটিক কোন কাজ করে না।
  • একবার এ এন্টিবায়োটিক সেবন করলে পরে আর এটি কাজ করে না।
  • জীবাণুর ল‍্যাগ পিরিয়ডে কোন কাজ করে না।
  • অস্থিমজ্জায় বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করে।
রেজিস্ট‍্যান্ট স্ট্রেইন এর ক্ষেত্রে নিম্নে উল্লিখিত এন্টিবায়োটিকসমূহ ব‍্যবহার করা যেতে পারে- অ‍্যামোক্সিসিলিন কট্রিমোক্সাজল, কুইনলস এর মধ্যে সিপ্রোফ্লক্সাসিন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। 
বর্তমানে বাংলাদেশে সিপ্রোফ্লক্সাসিন, পিফ্লক্সাসিন প্রভৃতির চিকিৎসায় খুব ভালো ফল পাওয়া গেছে। এর পাশাপাশি পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে এবং প্রচুর পরিমাণ পানি, ফলের জুস ও ডাবের পানি খেতে হবে। বেশি মসলাদার খাবার ও ভাজাপোড়া পরিহার করতে হবে।

বাঁধাকপি, ব্রকলি এবং অতিরিক্ত ফাইবার যুক্ত খ‍‍াদ‍্য খাবার তালিকায় রাখা যাবেনা। কুসুম গরম পানি দিয়ে গোসল করা যাবে। টাইফয়েড রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেলে অবশ্যই সাথে সাথে চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের শরণাপন্ন হবেন। এ ছিল টাইফয়েড এর প্রতিকার বা চিকিৎসা ব্যবস্থা।

টাইফয়েড এর প্রতিরোধ

টাইফয়েড এর প্রতিরোধ ব্যবস্থায় নিম্ন লিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
  • স‍্যানিটেশন ব‍্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে হবে।
  • বাহক চিহ্নিত করে তার চিকিৎসা দিতে হবে এবং বাহক কর্তৃক তৈরি খাদ্য গ্রহণ সম্পূর্ণরূপে বর্জন করতে হবে। বাহক যাতে কোন প্রকারেই পানীয় ও খাদ‍্যদ্রব‍্যের সংস্পর্শে না আসতে পারে সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে।
  • রোগীকে আলাদা রেখে চিকিৎসা দিতে হবে যাতে সুস্থ কোন লোক রোগীর সংস্পর্শে আসতে না পারে।
  • রোগীর মল-মূত্র এবং ব‍্যবহৃত জিনিসপত্র স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে বিনষ্ট করতে হবে।
  • বিশুদ্ধ পানি পান, পাস্তুরিত দুধ পান ও খাদ‍্য দ্রব‍্য সাবধানে স্থানান্তরের মাধ্যমে রোগ বিস্তার রোধ করতে হবে।
  • উচ্চ বিপদ সংকুল ব‍্যক্তির ক্ষেত্রে অতি সাবধানতার সাথে TAB Vaccine প্রদান করা যেতে পারে।
  • শিক্ষার হার বাড়াতে হবে এবং গণসচেতনতার মাধ্যমে টাইফয়েড রোগের বিরুদ্ধে গণ-জাগরণ গড়ে তুলতে হবে।

টাইফয়েড মেরীর গল্প

টাইফয়েড মেরীর গল্প : এ গল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের এক রাঁধুনি নাম মেরী মেলন। সে ১৮৯৬ সাল হতে ১৯০৬ সাল পর্যন্ত ঐ শহরে ৭ টি বাসায় রান্নার কাজ করছিল। ঐ সময়ে (১৯০৬ সালে) ডাক্তার সোপার নামক একজন প্রাণ চিকিৎসক টাইফয়েড রোগের কারণ খুঁজতে খুঁজতে মেরীর রান্না ঘরে ঢুকে পড়েছিলেন।

তখন মেরী ডাক্তার সোপারকে তার গবেষণার কাজে সাহায্য করেই নি বরং সে ডাক্তার সোপারকে তার হাতের রান্নার বাঁকানো ফর্ক নিয়ে তেড়ে এসেছিল। 

পরবর্তীতে ডাক্তার সোপার এর সন্দেহের যথার্থতা প্রমাণের জন‍্য নিউইয়র্ক এর স্বাস্থ্য বিভাগ মেরীকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে তাঁর মল পরীক্ষা করে টাইফয়েডের জীবাণু সনাক্ত করা হয়। যদিও এ রোগের কোন লক্ষণ তার দেহে ছিল না। ডাক্তার সোপার টাইফয়েড রোগের বাহক হিসেবে মেরী মেলন কে চিহ্নিত করেন। 

১৯০৮ সালে আমেরিকান মেডিক্যাল জার্নালে এর উপর একটি প্রবন্ধ বের হয় "টাইফয়েড মেরী" নামে। তখন থেকে তার নাম হয় টাইফয়েড মেরী। এ অবস্থায় স্থানীয় প্রশাসন তাকে রান্নার কাজে নিষেধাজ্ঞা জারী করে তাকে গৃহ বন্দী রাখার নির্দেশ প্রদান করে। এ বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেয়ে মেরী তার নাম পরিবর্তন করে পুনরায় রান্না রান্নার কাজ শুরু করে এবং টাইফয়েড রোগের জীবাণু ছড়াতে থাকে। 

সে কর্তৃপক্ষের হাতে পুনরায় ধরা পড়ে এবং তার কৃতকর্মের অপরাধে তাকে কারাগারে বন্দী করে। দীর্ঘ ২৩ বছর জেলে থেকে ১৯৩৮ সালে সে মারা যায়। মেরী মেলন বা টাইফয়েড মেরী তার জীবদ্দশায় ৫৩টি টাইফয়েড রোগীর সাথে সম্পৃক্ত ছিল এবং তাদের মধ্যে ৩ জন রোগী মারা গিয়েছিল। টাইফয়েড মেরীর গল্প থেকে আমদের শিক্ষা নেওয়া উচিত।

টাইফয়েড রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসা - টাইফয়েড মেরীর গল্প - লেখকের মন্তব্য

টাইফয়েড একটি জীবন হানিকর অসুখ। এই রোগ প্রতিরোধে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন জীবনযাপন করতে হবে এবং শিশুকালেই টিকা গ্রহণ করতে হবে। রোগের লক্ষণগুলো প্রকাশ পাওয়ার সাথে সাথেই রোগ সনাক্ত করার মাধ্যমে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে।
সম্মানিত পাঠক আমরা জানালাম টাইফয়েড জ্বর কেন হয়, টাইফয়েড রোগ যেভাবে ছড়ায়, টাইফয়েড রোগের লক্ষণ, টাইফয়েড এর প্রতিকার বা চিকিৎসা, টাইফয়েড এর প্রতিরোধ, টাইফয়েড মেরীর গল্প সম্পর্কে। আপনাদের কেমন লাগলো কমেন্ট করে জানান এবং শেয়ার করুন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

দি প্লেনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url