ডিপথেরিয়া রোগের কারণ, লক্ষণ, প্রতিরোধ ও যেভাবে ছড়ায়

ভাইরাসের উপকারিতা ও অপকারিতা জানুনসম্মানিত পাঠক, আপনি হয়তো ডিপথেরিয়া রোগের কারণ, ডিপথেরিয়া রোগ কিভাবে ছড়ায় ও ডিপথেরিয়া রোগের লক্ষণ অথবা ডিপথেরিয়া রোগ সম্পর্কে খুঁটিনাটি বিস্তারিত জানতে চান, তাহলে এই পোস্টটি মনোযোগ সহকারে শেষ পর্যন্ত পড়ুন।
ডিপথেরিয়া রোগের কারণ
এখানে আমরা উপরোক্ত বিষয়সহ ডিপথেরিয়া রোগের প্রতিকার, ডিপথেরিয়া রোগের প্রতিরোধ এবং ডিপথেরিয়া রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়ার নামও জানব।

ভূমিকা

ডিপথেরিয়া একটি ব্যাকটেরিয়া ঘটিত রোগ। বিজ্ঞানী Edwin Klebs ১৮৮৩ সালে আক্রান্ত রোগীর কণ্ঠনালী থেকে এ রোগের প্যাথোজেন ব্যাকটেরিয়াকে পৃথকীকরণ করেন এবং সনাক্ত করেন। ডিপথেরিয়া একপ্রকার বায়ু প্রবাহিত সংক্রামক রোগ।
পৃথিবীর দরিদ্র দেশগুলোতে এ রোগ বেশি পরিলক্ষিত হয়। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে যারা জনাকীর্ণ ঘন বস্তির স্বল্প আলো ও অধিক আর্দ্রতা যুক্ত নোংরা পরিবেশে বসবাস করে তাদের মধ্যে এ রোগ বেশি হয়ে থাকে। আমাদের দেশে সাধারণত ৫ বছরের কম বয়সী শিশুরা এ রোগে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে।

ডিপথেরিয়া রোগের কারণ

ডিপথেরিয়া রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়ার নাম Corynebacterium diphtheriae। এই ব্যাকটেরিয়ার কারণেই মূলত ডিপথেরিয়া রোগ হয়ে থাকে। এ ব্যাকটেরিয়া সরল দণ্ডাকার বা কিছুটা বক্র-দণ্ডাকৃতির। এ ব্যাকটেরিয়াকে তিনটি উপদলে বা বায়ো-টাইপে বিভক্ত করা হয়েছে। বায়োটাইপ তিনটি নিম্নরূপ-
  • গ্রেভিস (Gravis) টাইপ
  • মাইটিস (Mitis) টাইপ ও
  • ইন্টারমেডিয়াস (Intermedius) টাইপ।
উপরোক্ত এ তিনটি টাইপের মধ্যে গ্রেভিস টাইপ বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে বিদ্যমান। সংক্রামক হিসেবে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে মাইটিস টাইপ। সংক্রমণের হার সবচেয়ে কম পরিলক্ষিত হয়েছে তৃতীয় প্রকৃতির ইন্টারমেডিয়াস টাইপ দ্বারা সৃষ্ট রোগ।

ডিপথেরিয়া রোগ কিভাবে ছড়ায়

নিম্নলিখিত মাধ্যমে ডিপথেরিয়া রোগ ছড়ায়।
  • জীবাণু বহনকারী ব্যক্তির বা রোগীর মাধ্যমে এ রোগ ছড়িয়ে থাকে।
  • রোগীর ব্যবহৃত বাসনপত্র ও জামাকাপড় বিছানা পত্র প্রভৃতি এর বাহক হিসেবে কাজ করে।
  • অপরিশোধিত দুধ ও অন্যান্য পানীয়ের মাধ্যমে এ রোগ ছড়িয়ে থাকে।

ডিপথেরিয়া রোগের লক্ষণ

পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ডিপথেরিয়া রোগ মূলত শিশুদের বেশি হয়ে থাকে। এ রোগের জীবাণু Corynebacterium diphtheriae বায়ুর মাধ্যমে বাহিত হয়ে নাসারন্ধ্রের মাধ্যমে গলনালি ও শ্বাসনালীতে প্রবেশ করে ও সেখানে প্রাথমিক সংক্রমণ ঘটিয়ে থাকে। ফলে ১ থেকে ৭ দিনের মধ্যে নিম্নলিখিত লক্ষণ সমূহ প্রকাশ পেয়ে থাকে। ডিপথেরিয়া রোগের লক্ষণ গুলো হল-
  • প্রথমদিকে শ্বাসনালী সংক্রামিত হওয়ার পর আক্রান্ত রোগীর নাক দিয়ে মিউকাস মিশ্রিত পুঁজ বের হয়ে আসতে থাকে।
  • পরবর্তীতে গলনালি সংক্রমণের ফলে গলনালি ও শ্বাসনালীতে ক্ষত দেখা দেয় এবং একপর্যায়ে নাকের মধ্যেও ক্ষত পরিলক্ষিত হয়।
  • রোগীর শরীরে জ্বর হয় এবং সে সাথে মাথা ব্যথা ও বমি হতে থাকে।
  • টনসিল, কণ্ঠনালী ও গলনালি ফুলে যায় এবং তীব্র সংক্রমণে টনসিল, মুখের ঊর্ধ্ব-তালু, কণ্ঠনালী প্রভৃতি স্থানে সাদা সাদা আবরণের সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে আবরণী পর্দা গুলো একত্রিত হয়। গলনালিয় বৃহৎ অংশ ঢেকে দেয়।
  • কণ্ঠনালীর ক্ষত নাসিকা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।
  • ব্যাকটেরিয়া Exotoxin নামক একপ্রকার বিষাক্ত পদার্থ নিঃসৃত করে রোগীর শ্বাস-নালীর উপর ধূসর বর্ণের অলীক মেমব্রেন তৈরি করে ফলে ওই স্থান ফুলে যায়, ব্যথা হয় এবং রোগীর শ্বাসকষ্ট হতে থাকে।
  • উপরোক্ত অবস্থায় রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাস চলাকালে গর্-গর্ শব্দ হতে থাকে। কাশির সাথে কফ নিঃসৃত হতে থাকে।
  • ব্যাকটেরিয়া কর্তৃক সৃষ্ট Exotoxin পরিবহন তন্ত্রের মাধ্যমে দেহের সমস্ত অংশে ছড়িয়ে পড়ে এবং এর প্রভাবে রোগীর কিডনি, স্নায়ুতন্ত্র এমনকি হৃদপিণ্ড নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
  • তীব্র আক্রমণে রোগীর চোখ, কান, নাভি ও ত্বকে ঘা পরিলক্ষিত হয়।
  • দেহের যে অংশে ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রামিত হয় সেখানকার শ্লৈষ্মিক ঝিল্লীর প্রদাহ হয় এবং ক্রমশ সেখানে ক্ষতের সৃষ্টি হয় ফলে এক ধরনের Pseudomembrane সৃষ্টি হয়।

ডিপথেরিয়া রোগের প্রতিকার

  • ল্যাবরেটরিতে রোগের জীবাণু সনাক্ত করা পর্যন্ত অপেক্ষা না করে রোগীর শরীরে ডিপথেরিয়া রোগের লক্ষণ দেখার সাথে সাথেই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ডিপথেরিয়া রোগের প্রতিকার বা চিকিৎসা শুরু করা উচিত।
  • ডিপথেরিয়া জীবাণু নিশ্চিত আবার পর ডিপথেরিয়ার এন্টিটক্সিন প্রয়োগ করে জীবাণু কর্তৃক নিঃসৃত Exotoxin বা বহিঃবিষ এর কার্যকারিতা নষ্ট করা যায়। ডোজ হিসেবে ১০,০০০ থেকে ১৫,০০০ একক পর্যন্ত পেশীতে অথবা শিরাতে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
  • উপযুক্ত এন্টিবায়োটিক প্রয়োগের মাধ্যমেও ডিপথেরিয়া রোগের প্রতিকার সম্ভব। সাধারণত পেনিসিলিন এন্টিবায়োটিক হিসেবে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে।

ডিপথেরিয়া রোগের প্রতিরোধ

ডিপথেরিয়া রোগের প্রতিরোধ করতে নিম্নোলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে-
  • শিশুদের প্রতিষেধক টিকা প্রয়োগ অবশ্যই রোগের প্রকোপ কমায়।
  • DPT (Diphtheria-Pertussis-titanus vaccine) নামক টিকা প্রয়োগ করে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে ডিপথেরিয়া রোগের প্রতিরোধ কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। এই DPT টিকার নিয়ম অনুযায়ী শিশুর বয়স ৬ সপ্তাহ হলে প্রথম ডোজ টিকা দিতে হয় এবং পরবর্তী ১ মাস অন্তর অন্তর আরও ২টি টিকা দিতে হয়। শিশুর বয়স ৫ বছর হলে নির্ধারিত বুস্টার ডোজ দিতে হয়।
  • রোগীকে অবশ্যই অন্যদের থেকে আলাদা স্থানে রেখে চিকিৎসা করতে হবে।
  • রোগীর সংস্পর্শে যারা থাকবে তাদেরও টিকা দিতে হবে। প্রয়োজনে এন্টিবায়োটিক খাওয়াতে হবে। প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি রোগাক্রান্ত হয়েছে বলে সন্দেহ হলে তা নিশ্চিত হয়ে বিশুদ্ধ toxoid প্রয়োগ করতে হবে।
  • বাহক ব্যক্তি চিহ্নিত করে ডিপথেরিয়া রোগের চিকিৎসা দেয়া উচিত।
  • Schick test-এর মাধ্যমে সন্দেহ-প্রবণ ব্যক্তি নির্ণয় করা এবং যদি পাওয়া যায় তবে অবশ্যই তার টিকা প্রদান করা উচিত।

লেখকের মন্তব্য : ডিপথেরিয়া রোগের কারণ, লক্ষণ, প্রতিরোধ ও যেভাবে ছড়ায় জেনে নিন

আগে মানুষ ধারণা করত যে বিড়ালের দ্বারা ডিপথেরিয়ার জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে, কিন্তু এই ধারণাটি ভুল। আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি ও কাশির মাধ্যমে এই রোগের জীবাণুটি ছড়িয়ে পড়ে। তাই সেক্ষেত্রে আমাদের সচেতন থাকতে হবে।
আমরা জেনেছি ডিপথেরিয়া রোগের কারণ, ডিপথেরিয়া রোগ কিভাবে ছড়ায়, ডিপথেরিয়া রোগের লক্ষণ, ডিপথেরিয়া রোগের প্রতিকার ও ডিপথেরিয়া রোগের প্রতিরোধ সম্পর্কে। এসব তথ্য অবশই শেয়ার করবেন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

দি প্লেনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url