ধনুষ্টংকার রোগের লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধ - ধনুষ্টংকার রোগ কিভাবে ছড়ায়

হার্ট ভালো আছে বুঝার উপায়প্রিয় পাঠক, আপনি কি ধনুষ্টংকার রোগের জীবাণুর নাম কি, ধনুষ্টংকার রোগের লক্ষণ, ধনুষ্টংকার রোগ কিভাবে ছড়ায়, ধনুষ্টংকার রোগের চিকিৎসা ও প্রতিরোধ সম্পর্কে জানতে চান? তাহলে এই আর্টিকেলটি আপনার জন্য। ধনুষ্টংকার সম্পর্কে খুঁটিনাটি জানতে পুরো আর্টিকেলটি মনোযোগ সহকারে পড়ুন।
ধনুষ্টংকার রোগের লক্ষণ
উপরোক্ত পয়েন্টগুলো ছাড়াও এখানে ধনুষ্টংকার রোগের বিষয়ে আমরা আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরব যা আশাকরি আপনাদের সকলের উপকারে আসবে।

ভূমিকা

ধনুষ্টংকার মানবদেহের একটি নিউরোটক্সিক রোগ বিশেষ। শিশুদের ছয়টি মারাত্মক রোগের মধ্যে এটি অন্যতম। তবে বড়দেরও এ রোগ হয়ে থাকে। এ রোগে আক্রান্ত রোগীর মুখের পেশির খিঁচুনির ফলে চোয়াল আটকে যায় বলে এ রোগকে লক জো (Lock jaw) রোগ বলা হয়ে থাকে।

সমস্ত পৃথিবীব্যাপী এ রোগ বিস্তৃত। কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করায় পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে এ রোগের নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশে এ রোগের প্রকোপ এখনো মারাত্মক পর্যায়ে রয়েছে।

ধনুষ্টংকার রোগের জীবাণুর নাম কি

টিটেনাস বা ধনুষ্টংকার রোগের জীবাণু এক প্রকার ব্যাকটেরিয়া। এ ব্যাকটেরিয়ার নাম ক্লোস্ট্রিডিয়াম টেটানি। প্রকৃতিতে যত্রতত্র এই ব্যাকটেরিয়া বিরাজমান। তবে মাটিই হচ্ছে এদের মূল আবাস। ধুলাবালি, মানুষ ও গৃহপালিত পশুর মলে এ ব্যাকটেরিয়া পাওয়া যায়। 
খাদ্য হিসাবে মানুষ এবং পশু শাকসবজি, ঘাস খাওয়ার মাধ্যমে এই ব্যাকটেরিয়া মানুষ এবং প্রাণীর অন্ত্রে প্রবেশ করে। সেখানে এরা মৃতজীবী এবং কমনসেল বা সহবাসী হিসেবে বাস করে এবং মানুষ ও প্রাণীর মল থেকে এ ব্যাকটেরিয়া সহজেই পৃথক করা যায়। ক্লোস্ট্রিডিয়াম টেটানি ব্যাকটেরিয়ার বৈশিষ্ট্য গুলো নিম্নে উল্লেখ করা হল -
  • গোলাকার প্রান্ত বিশিষ্ট দণ্ডাকার ব্যাকটেরিয়া।
  • ব্যাকটেরিয়ার কোষগুলো লম্বায় ২-৫ মাইক্রোমিটার এবং প্রস্থে ০.৪-০.৫ মাইক্রোমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে।
  • গোলাকার, প্রান্তীয় স্পোর উৎপন্ন করে এবং স্পোরগুলো দেহ কোষের চেয়ে বড় হয়ে থাকে। স্পোরযুক্ত দণ্ডকার এ ব্যাকটেরিয়াগুলো দেখতে অনেকটা ঢাকের কাঠির মতো হয়ে থাকে।
  • এরা সচল, পেরিট্রাইকাস ফ্লাজেলাযুক্ত এবং ক্যাপসুল বিহীন।
  • এদের বৃদ্ধির সুষম তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
  • সাধারণ কালচার মিডিয়াতে এরা জন্মাতে পারে তবে রক্ত বা সিরামের উপস্থিতিতে এরা ভালো জন্মে। রক্তযুক্ত মিডিয়াতে ক্লোস্ট্রিডিয়াম টেটানি হিমোলাইটিক অঞ্চল তৈরি করে।
  • ফুটন্ত পানিতে প্রায় ৪০ থেকে ৬০ মিনিট পর্যন্ত এ ব্যাকটেরিয়ার স্পোর টিকে থাকতে পারে। ১৫০ ডিগ্রী সেলসিয়াস শুষ্ক তাপে স্পোর দু'ঘণ্টা কাল এবং ৫% ফেনলে ২ সপ্তাহ টিকে থাকতে পারে।
  • এ ব্যাকটেরিয়ার স্পোরগুলোর মৃত্যু ঘটে ১২০ ডিগ্রী সেলসিয়াস এবং ২০ মিনিট কাল বাষ্পীয় তাপে; আয়োডিন এর জলীয় দ্রবণে কয়েক ঘণ্টা রাখলে।
  • এরা অত্যন্ত শক্তিশালী বহিঃবিষ উৎপাদন করে
  • এদের এন্টিজেনিক বৈশিষ্ট্যও রয়েছে যা এন্টিটক্সিন উৎপন্ন করে থাকে।

ধনুষ্টংকার রোগ কিভাবে ছড়ায়

এ রোগের ব্যাকটেরিয়া মানুষের দেহে প্রবেশ করে ত্বকের ক্ষতস্থানের মাধ্যমে। অন্ত্রে বসবাসকারী এ ব্যাকটেরিয়া কোন রোগ সৃষ্টি করে না। এরা মলের সাথে দেহের বাহিরে বেরিয়ে আসে। ধুলাবালি, পশুর মল বিশেষ করে শুষ্ক ঘোড়ার মল প্রভৃতির মাধ্যমে মানুষের দেহের ক্ষতস্থানের মধ্যে এই জীবাণু শরীরে প্রবেশ করে। 

ছুরি, কাঁচি, ব্লেড কারখানায় যন্ত্র চালানো বা যানবাহনে দুর্ঘটনার কারণে শরীরের কোন অংশ কেটে গিয়ে রক্তপাত হলে ক্লোস্ট্রিডিয়াম টেটানি ব্যাকটেরিয়া মানবদেহে প্রবেশ করতে পারে। শিশুর জন্মের পর পুরানো বা মরচে ধরা ছুরি, বা ব্লেডের সাহায্যে নাভি বা নাড়ী কাটার সময় ব্যাকটেরিয়া শরীরে প্রবেশ করতে পারে। 
শরীরের কোন অংশ গভীরভাবে ফেটে গেলে বা আঘাতের ফলে সৃষ্ট ক্ষত, ধুলাবালি বা মাটির সংস্পর্শে এলে রক্ত জমাট বাঁধলে কাটা টিস্যুর অংশবিশেষ বা ছোট কাপড়ের টুকরা ক্ষতে আটকে গেলে টিটেনাসের স্পোর সেখানে অঙ্কুরিত হয়। স্পোর অঙ্কুরিত হবার পর জীবাণু উক্ত স্থানে সংখ্যা বৃদ্ধি করে এবং বহিঃবিষ নিঃসৃত করে। 

সেখানে এই বহিঃবিষ টিস্যুর মটর ইন্ড-প্লেট দ্বারা শোষিত হয় এবং পরবর্তীতে মটরনার্ভ দ্বারা বাহিত হয়ে স্পাইনাল কর্ডের প্রান্তীয় কাটার কোষে পৌঁছে। সেখানে টক্সিন স্নায়ুকোষের সাথে স্থায়ী ভাবে যুক্ত হয় যার ফলে অসহ্য যন্ত্রণার (জ্বালাপোড়া) সৃষ্টি হয়। 

টক্সিন পরে বিপরীত পাশের কশেরুকার অংশে স্থানান্তরিত হয় এবং ক্রমশ দেহের উপরের দিকে (স্নায়ু কোষের দিকে) এবং নিচের দিকে (পায়ের অংশে) ছড়িয়ে পড়ে ক্রিয়া করে। এভাবে এ টক্সিনের ক্রিয়ার ফলে ধীরে ধীরে রোগের লক্ষণ সমূহ প্রায় ১০ থেকে ১৬ দিনের মধ্যে প্রকাশ পায়।

ধনুষ্টংকার রোগের লক্ষণ

টিটেনাস বা ধনুষ্টংকার রোগে আক্রান্ত রোগীর দেহে নিম্নলিখিত ধনুষ্টংকার রোগের লক্ষণ সমূহ প্রকাশ পায় :
  • শরীরের মাংস পেশির মারাত্মক সংকোচনশীলতা পরিলক্ষিত হয়। হলে মাংসপেশিতে টান ধরে এবং প্রচণ্ড যন্ত্রণা হয়।
  • চোয়ালের মাংসপেশি শক্ত হয়ে যায় এবং চোয়াল আটকে যায়। রোগী মুখ খুলতে পারে না।
  • কঙ্কালের মাংসপেশিতে টানের ফলে রোগীর দেহের পশ্চাৎ অংশ অর্থাৎ পা মাথার দিকে ধনুকের মতো বেঁকে যায়।
  • প্রান্তীয় প্রতিক্রিয়ার ফলে ঐচ্ছিক পেশিগুলো শক্ত হয়ে যায়।
  • ক্রমশ রোগীর ঘাড়, চিবুক এবং পিঠের পেশি শক্ত হতে থাকে।
  • রোগী কোন প্রকার খাদ্য গলাধঃকরণ করতে পারে না।
  • শ্বাসনালীর পেশি সংকোচনের ফলে শ্বাস কষ্ট দেখা দেয় এবং মধ্যচ্ছদা বা ডায়াফ্রাম ও শ্বাসযন্ত্রের পেশির সংকোচনের ফলে চূড়ান্ত পর্যায়ে রোগীর মৃত্যু হতে পারে।

ধনুষ্টংকার রোগের চিকিৎসা

রোগ সনাক্ত হওয়ার সাথে সাথে যত দ্রুত সম্ভব টিটেনাস এর এন্টিটক্সিন IV ২০,০০০ iu একক প্রয়োগ করা। এখানে লক্ষ্য রাখতে হবে যে রোগীর যদি ঘোড়ার সিরামের প্রতি অ‍্যালার্জি থাকে তবে টিটেনাস এর এন্টিটক্সিন-টি ভেড়া, খরগোশ বা মানুষের সিরাম দিয়ে তৈরি হতে হবে। 
আরও উল্লেখ করা যায় যে, একবার টিটেনাস এর টক্সিন স্নায়ু কলায় যুক্ত হয়ে গেলে তা আর প্রশমিত করা যায় না তাই এন্টিটক্সিনের চিকিৎসা জরুরি ভিত্তিতে করতে হয়। টিটেনাসের চিকিৎসা খুব কার্যকরী হয় না। প্রায় শতকরা ৩০-৯০ ভাগ ক্ষেত্রেই রোগীর মৃত্যু ঘটে। এন্টিটক্সিন প্রয়োগের এক ঘণ্টা পর ক্ষতের চিকিৎসা শুরু করা উচিত।

ক্ষত সারাতে পেনিসিলিন এন্টিবায়োটিক বিশেষ করে বেনজাইল পেনিসিলিন ৫,০০,০০০ একক দিনে ২ বার প্রয়োগ করা। রোগীকে যন্ত্রণার হাত থেকে শান্ত রাখার জন্য নিরিবিলি কক্ষে রাখা, ঘুমের জন্য ডাইজেপাম প্রয়োগ করা যেতে পারে। নিয়ম মাফিক পুষ্টিযুক্ত খাবার ও পানীয় প্রদান করা।

ধনুষ্টংকার রোগের প্রতিরোধ

ধনুষ্টংকার রোগের প্রতিরোধ করতে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ নিতে হবে -
  • শিশুদের অবশ্যই টিকা প্রদান করা। ম্যালেরিয়া রোগের সৃষ্টি হয় এমন সময় বাদ দিয়ে টিকা প্রদানের সময় নির্ধারণ করতে হয়। DPT কর্মসূচির সাথে টিটেনাস টক্সয়েডও দেয়া হয়। শিশু জন্মের ছয় সপ্তাহ (দেড় মাস) পর প্রথম ডোজ টিকা দিতে হয়। পরবর্তীতে এক মাস অন্তর অন্তর আরও দুইটি টিকা দিতে হয়। শিশু বয়স চার থেকে ছয় বছরের মধ্যে চূড়ান্ত বা বুস্টার ডোজ দিতে হয়। একটি মাত্র বুস্টার ডোজই ১০-১২ বছর পর্যন্ত এ রোগ প্রতিরোধ করতে পারে।
  • পূর্বে টিকা গ্রহণ করেছে এমন ব্যক্তির দেহের কোন অংশ গভীরভাবে কেটে গেলে বা কোন কারণে টিটেনাস হতে পারে এমন সন্দেহ হলে টক্সয়েড (ATS)-এর বুস্টার ডোজ দিতে হবে।
  • টিটেনাসের ক্ষত নিরাময়ের জন‍্য পেনিসিলিন জাতীয় এন্টিবায়োটিক প্রয়োগ করতে হয়।
  • টিকা গ্রহণ করেনি এমন ব‍্যক্তির শরীরে টিটেনাস এর শঙ্কাযুক্ত ঘা বা ক্ষত হলে তার ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রকারের চিকিৎসা ও সতর্কতামূলক ব‍্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। ব‍্যবস্থাগুলো হলো - রোগীর সাবকিউটিনাস পেশীকলাতে ১৫০০ এককের ATS ইনজেকশন দিতে হবে। রোগী যদি ATS-এর প্রতি সংবেদনশীল হয় তবে সে ক্ষেত্রে মানুষে সিরাম তৈরি এন্টিটক্সিন ২৫০-৫০০ একক পেশিতে প্রয়োগ করতে হয়। এর ফলে ২-৪ সপ্তাহের মধ্যে ভালো ফল পাওয়া যায়। উপরে উল্লিখিত টিটেনাস টক্সয়েড এর ডোজটি পুনরায় ১ মাস পর ও পরে ৬ মাস পর পেশিতে ইনজেকশনের মাধ্যমে প্রয়োগ করতে হয়।
  • গর্ভবতী মহিলাদের টিকা প্রদানের মাধ্যমে মা ও শিশু উভয়ের এ রোগ থেকে রক্ষা সম্ভব।

উপসংহার : ধনুষ্টংকার রোগের লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধ - ধনুষ্টংকার রোগ কিভাবে ছড়ায়

এক জরিপে জানা গেছে কুমিল্লা জেলায় বৎসরে ১৫০ টি অস্বাভাবিক মৃত্যুর মধ্যে শতকরা ৮ ভাগ ছিল টিটেনাস রোগে আক্রান্ত মৃত্যু। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে স্থায়ীভাবে শিশুদের টিটেনাস রোগকে তাকুরিয়া বলা হয়। অন্য এক জরিপে জানা যায় এ তাকুরিয়া রোগে এক বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যু হার ১০%। এজন্য শিশুদের অনেক আগলে রাখতে হবে।
ছোট-বড় সবার কোন ধরনের ক্ষত হলে সঠিক চিকিৎসা নিতে হবে এবং ধনুষ্টংকার রোগের লক্ষণ সমূহ প্রকাশ পেলে দ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবেন। আমরা আজকে জানলাম ধনুষ্টংকার রোগের জীবাণুর নাম কি, ধনুষ্টংকার রোগ কিভাবে ছড়ায়, ধনুষ্টংকার রোগের লক্ষণ, ধনুষ্টংকার রোগের চিকিৎসা এবং ধনুষ্টংকার রোগের প্রতিরোধ সম্পর্কে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

দি প্লেনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url