এইডস রোগ কিভাবে ছড়ায়, লক্ষণ, প্রতিরোধ ও চিকিৎসা

ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসাসম্মানিত পাঠক, আপনি হয়তো এইডস রোগ কিভাবে ছড়ায়, এইডস রোগের লক্ষণ ও এইডস রোগের চিকিৎসা, এইচআইভি (HIV) এর গঠন ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অনেক খুঁজাখুঁজি করেও আপনি আপনার কাঙ্ক্ষিত উত্তরটি পাচ্ছেন না, আপনার কাঙ্ক্ষিত উত্তরটি পেতে অথবা এইডস সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এই কন্টেন্ট মনোযোগ সহকারে শেষ পর্যন্ত পড়ুন।
এইডস রোগ কিভাবে ছড়ায়
এখানে আমরা উপরোক্ত পয়েন্টগুলো এবং এইডস রোগের কারণ ও এইডস রোগের প্রতিরোধ সহ আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরব যা সবার জন‍্য জানা খুবই জরুরি।

ভূমিকা

যুক্তরাষ্ট্রের লস এঞ্জেলস, নিউইয়র্ক, আটলান্টা প্রভৃতি মেট্রোপলিটন শহরগুলোতে সর্বপ্রথম ১৯৮১ সালে এইডস (Acquired Immune Deficiency Syndrome) রোগ সম্পর্কে জানা যায়। উক্ত সময়ের গ্রীষ্মকালে সমকামীদের মধ্যে এক জড়িপ চালিয়ে এইডস রোগ সনাক্ত করা হয়েছিল। সেরোলজিক‍্যাল পরীক্ষার মাধ্যমে জানা যায় এইডস রোগের জন্য দায়ী ভাইরাস ১৯৭৯ সালের পূর্বে মানুষের দেহে উপস্থিত ছিল না। 
ধারণা করা হয় এ রোগের ভাইরাস ছিল বানরের দেহে। গবেষণায় জানা যায় সর্বপ্রথম আফ্রিকায় এইডস রোগের ভাইরাস বানরের দেহ থেকে মানুষের দেহে স্থানান্তরিত হয় এবং পরে তা আমেরিকা ও ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে।

এইডস রোগের কারণ

এইডস রোগের কারণ হলো এইচআইভি ভাইরাস। এইচআইভি (HIV) ভাইরাসের আক্রমণের ফলে এইডস রোগ হয়। ১৯৮৩ সালে ফ্রান্সের পাস্তুর ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী Dr. Lue Montagnier এবং আমেরিকার ন্যাশনাল কেমিক্যাল ইনস্টিটিউট (NCI) এর প্রধান Dr. Robert Gallo ১৯৮৪ সালে পৃথকভাবে এইডস এর ভাইরাস আবিষ্কার করেন। প্রথম দিকে যার নাম ছিল HTLV-3 বা LAV যা বতর্মানে HIV-1 নামে পরিচিত। 

১৯৮৫ সালে পশ্চিম আফ্রিকায় HIV-2 সনাক্ত করা হয়েছিল। ঐ একই বছরে HIV সনাক্তকরণে এন্টিবডি আবিষ্কৃত হয়। বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে এইডস সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্কের সৃষ্টি করে। ১৯৮৬ সালে আন্তর্জাতিক ভাইরাস নামকরণ কমিটি এ ভাইরাসের নাম দেন এইচআইভি (HIV) যার পূর্ণরূপ Human Immune Deficiency Virus।

এইচআইভি (HIV) এর গঠন ও বৈশিষ্ট্য

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, এইচআইভি (HIV) এর দুটি এন্টিজেনিক গ্রুপ আছে। গ্রুপ দুটি হচ্ছে
  • HIV-1
  • HIV-2
এই ভাইরাস-দ্বয় লেন্টিভাইরাস গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত। HIV এর গঠন বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ :
  • এইচআইভি একটি গোলাকৃতির ভাইরাস এবং এর দেহের চারপাশে ১০০ nm (ন‍্যানোমিটার) পুরু দ্বিস্তর বিশিষ্ট প্রোটিন আবরণ আছে।
  • এই প্রোটিন আবরণের উপর কাঁটা খিল-এর ন্যায় গ্লাইকোপ্রোটিন যুক্ত থাকে।
  • এই গ্লাইকোপ্রোটিনের দুটি অংশ থাকে। মাথার অংশটি হেক্সামার। একে GP-120 বলে যা পোষক কোষের সাথে যুক্ত হতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দ্বিতীয় অংশটি GP-41। এ দুটি অংশ রাসায়নিক-ভাবে যুক্ত থাকে। গ্লাইকোপ্রোটিনের এ গঠন সংক্রমণ প্রতিরোধকারী এন্টিবডিকে নিউট্রাল করে ফেলে।
  • বাইরের প্রোটিন আবরণের অভ্যন্তরে নাশপাতি আকৃতির প্রোটিন অণুর কোর থাকে যা p-24 নামে পরিচিত।
  • ভাইরাসের সর্ববাইরের স্তর হচ্ছে দ্বিস্তরী লিপিড যুক্ত যার সাথে গ্লাইকোপ্রোটিনের এন্টিজেন যুক্ত।

এইডস রোগ কিভাবে ছড়ায়

এইডস একটি সংক্রামক ব্যাধি। যদিও প্রকৃতপক্ষে এইডস কোন বিশেষ প্রকৃতির রোগ নয়। HIV কর্তৃক সংক্রমণের ফলে রোগীর শরীরে সংক্রমণ উত্তর অবস্থাকেই (HIV post infection condition) এইডস বলা হয়ে থাকে যার ফলে রোগীর শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পূর্ণরূপে নষ্ট হয়ে যায়। বিভিন্নভাবে একজন সুস্থ মানুষের শরীরে এ রোগের ভাইরাস প্রবেশ করতে পারে। এইডস রোগ যেভাবে ছড়ায় -
  • আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে মেলামেশা করলে।
  • সংক্রামিত সুঁচ ব্যবহারের মাধ্যমে।
  • আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত কোন ভাবে নিজের শরীরে প্রবেশ করালে।
HIV সংক্রামিত মায়ের গর্ভে জন্মগ্রহণকারী শতকরা ৯০ ভাগ শিশু HIV দ্বারা সংক্রামিত হয়-
  • গর্ভাসঞ্চারের সময়,
  • জন্মের সময় অথবা
  • বুকের দুধ খাওয়ানোর সময়।
মানব শরীরের এইসব তরল পদার্থগুলো গ্রহণের মাধ্যমেই সচরাচর এইডস রোগ বা এইচআইভি ছড়িয়ে থাকে। এইডস রোগে আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর হার শতকরা ৯২ থেকে ১০০ ভাগ। পুরুষের ক্ষেত্রে এ হার শতকরা ৯২.৫ ভাগ। মহিলা শতকরা ৬.৫ ভাগ এবং শিশুদের ক্ষেত্রে শতকরা ১.০ ভাগ পরিলক্ষিত হয়। 
HIV সংক্রমণের ফলে ধীরে ধীরে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। ফলে রোগী কোন প্রকার সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে আর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে না। তাই রোগীর শরীরে একটির পর একটি সংক্রমণ চলতেই থাকে।

এইডস রোগের লক্ষণ

HIV আক্রমণের ফলে রোগীর শরীরে রক্তের শ্বেত কণিকা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ধীরে ধীরে নিম্নলিখিত লক্ষণ সমূহ প্রকাশ পেতে থাকে। এইডস রোগের লক্ষণ গুলো হল -
  • এইডস আক্রান্ত রোগীর গায়ে জ্বর আসে। মাঝে মাঝে থেমে গিয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে এ জ্বর দীর্ঘায়িত হয়ে থাকে।
  • রোগীর দেহের গ্রন্থি ফুলে যায়, শরীর শুকিয়ে যায় এবং ওজন কমতে থাকে
  • ক্রমশ ফুসফুস সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়, বুকে ব্যথা হয় ও শুষ্ক কফ জমে।
  • পেটে ব্যথা হয় ও খাবারের প্রতি অনীহা দেখা দেয়।
  • রোগী বারবার অল্প অল্প করে মলত্যাগ করতে থাকে ও অস্বস্তি বোধ করে।
  • রাতে ঘাম হয় এবং হাড়ের জয়েন্টে বা অস্থিসন্ধিতে ব্যথা ও জ্বালাপোড়া হয়।
  • রোগীর সার্বক্ষণিকভাবে মাথা ব্যথা হয় এবং ধীরে ধীরে স্মৃতিশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি হারাতে থাকে।
  • ক্রমশ ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন ঘটে, এমনকি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলে ও ম্যালিগন্যান্সির সৃষ্টি হয়।
  • সংক্রমনের চূড়ান্ত পর্যায়ে যক্ষ্মানিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, অন্ধত্ব প্রভৃতি একাধিক রোগে আক্রান্ত হয়ে সম্পূর্ণরূপে প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে রোগী মৃত্যুবরণ করে।

এইডস রোগের প্রতিরোধ

১৯৯৮ সালে জেনেভাতে বিশ্ব এইডস সম্মেলন থেকে এটা সুস্পষ্ট হয়েছে যে, চিকিৎসার মাধ্যমে এইডস নিরাময়ের তেমন কোন ঔষধ আজ পর্যন্তও আবিষ্কৃত হয়নি। অপরদিকে কার্যকরী টিকা আবিষ্কারের প্রচেষ্টাও অব্যাহত আছে। তাই অপ্রতিরোধ‍্য জীবন হননকারী এ মহাব‍্যাধি এইডস এর ছোবল হতে রক্ষা পেতে হলে এইডস রোগের প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থা তথা রোগের বিস্তার রোধ করা একান্তই প্রয়োজন। এইডস রোগের প্রতিরোধ নিম্নলিখিত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা অতি জরুরী-
  • শিক্ষার প্রসার ঘটানো। ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা।
  • প্রতিবছর ১লা ডিসেম্বর বিশ্ব এইডস দিবস উদযাপন করে এইডস সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা।
  • রক্তের screening এবং heat treatment এর মাধ্যমে ভাইরাস ধ্বংস করে দেয়া।
  • এইডস এর ভয়াবহতা সম্পর্কে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাহায্যে ব্যাপক প্রচার করে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা।
  • অনিরাপদ যৌন মিলন সম্পর্কে জনগণকে সতর্ক করা।
  • শিরার মাধ্যমে মাদক গ্রহণকারীদের একই সুঁচ ব‍্যবহারের ভয়াবহতা সম্পর্কে সতর্ককরণ।
  • বহুগামিতা পরিহার করা এবং সমকামী হওয়া থেকে সম্পূর্ণরূপে বিরত থাকা। অস্বাভাবিক যৌন মিলন পরিহার করা।
  • HIV সন্দেহ প্রবণ ব‍্যক্তির নিয়মিত নির্ধারিত পরীক্ষাগুলো সম্পন্ন করা।
  • সেলুনে একই ব‍্যক্তির ব‍্যবহৃত ব্লেড একাধিক জনে ব‍্যবহার পরিহার করা।
  • হাসপাতালে শল্য চিকিৎসায় এবং দন্ত চিকিৎসায় ব‍্যবহৃত যন্ত্রপাতি যথাযথভাবে জীবাণুমুক্ত করা।
  • সংক্রামিত বা বাহক ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে সম্পূর্ণরূপে আলাদা রেখে যথাযথ চিকিৎসা দেয়া অথবা সীমিত চলাচলের সুবিধা দিয়ে চিকিৎসা করা।

এইডস রোগের চিকিৎসা

যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্সিস (Praxis) ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি এইডস রোগের চিকিৎসায় AL-721 নামে একটি ঔষধ বাজারজাত করে, এটা মূলত নিরপেক্ষ লিপিড দ্রবণ। কমলার রসের সাথে এটি পান করা হয়। ধারণা করা হয় "AL-721" এইচআইভি (HIV) এর বহিঃস্থ কোলেস্টেরল আবরণ কে ধ্বংস করে ভাইরাসের শ্বেত রক্তকণিকা আক্রমণে বাঁধা দেয়।

পরবর্তীতে অন্য এক গবেষণায় জানা গেছে যে, Azidothymidine এইডস ভাইরাসের অনুলিপনে বাঁধা দেয়। এ ঔষধ এইচআইভি অনুলিপনের অন‍্যতম প্রয়োজনীয় এনজাইম রিভার্স ট্রান্সক্রিপটেজকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। দক্ষিণ আমেরিকার পেরুর লিমা নেভাল হাসপাতালের একজন চিকিৎসক Dr. Rumberto Muro আমাজন মহাবনের Rubiaceae পরিবারের একটি লতানো উদ্ভিদ Uncaria tomentosa এইডস এর বিরুদ্ধে কার্যকরী বলে দাবি করেন। 

এমনকি তিনি এইডস আক্রান্ত ৭ জন রোগীকে উক্ত গাছ দ্বারা চিকিৎসার ফলে তাদের সুস্থ করে তুলেন বলে দাবি করেন। ২০০৫ সালে আমেরিকান বিজ্ঞানীগণ এইডস এর চিকিৎসায় Cotrimoxazole নামক এন্টিবায়োটিক প্রয়োগের সফলতা প্রকাশ করেন। তাঁরা দাবি করেন যে, cotrimoxazole এইডস নিরাময় করতে না পারলেও সাময়িকভাবে রোগীকে আরাম প্রদান করতে পারে।

উপরোক্ত ঔষধ গুলো ছাড়াও এইডস রোগের চিকিৎসায় বহুল ব্যবহৃত ঔষধগুলো হচ্ছে পেন্টামিডাইল ইনহেলেশন, ফ্লুকুনাজোল, পাইরিমিথামাইন ও সালফাডাইয়াজিন এর মিশ্রণ। ডেক্সটান সালফেট, ডাইডিঅক্সিসাইটোসিন, ডাইডিঅক্সিআইনোসিন, ক্লোফাজাইমিন, রিফামপিসিন + এমাইকেসিন এর মিশ্রণ, রিফাবিউটিন, সুরামিন ও রিবাভারিন প্রভৃতি।

এইডস রোগের চিকিৎসায় একটি কার্যকরী ভ্যাকসিন আবিষ্কারের প্রচেষ্টা সারা বিশ্বব্যাপী চলছে। আজও এ চেষ্টা সফল হয়নি কারণ এইডস ভাইরাস প্রতিনিয়ত তাঁর এন্টিজেনিক বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করে চলছে।

লেখকের মন্তব্য : এইডস রোগ কিভাবে ছড়ায়, লক্ষণ, প্রতিরোধ ও চিকিৎসা

১৯৯৬ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এর জরিপ অনুযায়ী সারা বিশ্বে এইডস রোগীর সংখ‍্যা ছিল ১,৯০০,০০,০০০ জন। বর্তমানে এ সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৪,০০,০০,০০০ জন। ১৯৯৭ সালে বিশ্বব‍্যাপী এইডস রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যায় ২৩,০০,০০০ জন। এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত হলে ১ বছরের মধ‍্যে মানুষ মারা যায়। তবে চিকিৎসা করতে থাকলে ৫ বছর পর্যন্ত রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হয়।

বাংলাদেশে এইডস রোগাক্রান্ত মানুষের সংখ‍্যা প্রায় ২ হাজার মানুষ। ১৯৮২ সালে এইডস রোগকে ক্লিনিক্যালি সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ বলে অভিহিত করা হয়। এইডস এর পরিণতি নিশ্চিত মৃত্যু। এজন্য আমাদের সকলকে সচেতন থাকতে হবে।

সম্মানিত পাঠক, এইডস রোগের কারণ, এইডস রোগ কিভাবে ছড়ায়, এইডস রোগের লক্ষণ, এইডস রোগের প্রতিরোধ এবং এইডস রোগের চিকিৎসা সম্পর্কে জানলাম। এই আর্টিকেলটি মানুষের সেবায় শেয়ার করুন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

দি প্লেনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url