হাঁসের মাংসের উপকারিতা ও অপকারিতাসম্মানিত পাঠক আজকে আমরা শূকরের মাংসের উপকারিতা ও অপকারিতা, শূকরের মাংস হারাম কেন, হিন্দুরা কি শূকরের মাংস খায় সে সম্পর্কে আপনাকে জানাব।
শূকরের মাংসের ক্ষতিকর দিক সহ শূকরের মাংস চেনার উপায়, শূকর সৃষ্টির ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনা করব। আজকের এই আর্টিকেলটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে তাই মনোযোগ সহকারে পড়ুন।
ভূমিকা : শূকরের মাংসের উপকারিতা ও অপকারিতা
ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে এবং বিভিন্ন ধর্মে শূকর একটি অপবিত্র প্রাণী এবং এটির মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ। এটি হিংস্র প্রাণীও বটে। শূকরের মাংস অনেকেই খেয়ে থাকে। শূকরের মাংসের কিছু উপকারিতা থাকলেও এর অপকারিতা-ই বেশি। পৃথিবীর প্রায় সব জায়গাতেই শূকর দেখা যায়। শূকরের মাংসকে পর্ক বলা হয়।
শূকরের মাংসের উপকারিতা
পুষ্টিগুণ : শূকরের প্রতি ১০০ গ্রাম মাংসে নিম্নলিখিত পুষ্টিগুণ থাকে।
- ক্যালরি: ১০৯ কিলোক্যালরি
- প্রোটিন: ২১ গ্রাম
- চর্বি: ২.১৭
- ম্যাগনেসিয়াম: ২৭ মিলিগ্রাম
- ফসফরাস: ২৪৭ মিলিগ্রাম
- পটাশিয়াম: ৩৯৯ মিলিগ্রাম
- আয়রন: ০.৯৮ মিলিগ্রাম
- থায়ামিন: ০.৯৯৮ মিলিগ্রাম
প্রোটিন : চর্বিহীন শূকরের মাংসে প্রচুর প্রোটিন থাকে। শূকরের মাংস আপনার শরীরের বৃদ্ধি এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় ৯টি অ্যামাইনো অ্যাসিড সরবরাহ করে।
শূকরের চর্বি : শূকরের মাংসে চর্বির পরিমাণ অনেক বেশি থাকে। এখানে স্যাচুরেটেড ফ্যাটও রয়েছে।
খনিজ এবং ভিটামিন : শূকরের মাংসে প্রচুর পরিমাণে খনিজ এবং ভিটামিন রয়েছে। যেমন –
- থায়ামিন : গরুর এবং ভেড়ার মাংসের তুলনায় শূকরের মাংসে ব্যতিক্রমী ভাবে থায়ামিন বেশি থাকে। এটি একটি বি ভিটামিন যা শরীরের বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
- সেলেনিয়াম : শুয়োরের মাংসে প্রচুর পরিমাণে সেলেনিয়াম রয়েছে।
- জিঙ্ক : জিঙ্ক একটি অত্যাবশ্যক খনিজ যা শূকরের মাংসে প্রচুর পরিমাণে থাকে এবং একটি সুস্থ ইমিউন সিস্টেম বজায় রাখে।
- ভিটামিন বি১২ : এটি একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন। ভিটামিন বি১২ রক্ত উৎপাদন এবং মস্তিষ্কের কার্যকারিতার জন্য প্রয়োজনীয় একটি উপাদান। এই ভিটামিনের অভাবে রক্তস্বল্পতা এবং নিউরোনাল ক্ষতি হতে পারে।
- নিয়াসিন : এটি ভিটামিন বি৩ নামে পরিচিত, যা শরীরের বৃদ্ধি এবং বিপাকসহ বিভিন্ন কাজ করে।
- ফসফরাস : শূকরের মাংসের প্রচুর ফসফরাস রয়েছে, যা শারীরিক বিকাশ এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজন হয়।
- আয়রন : শূকরের মাংস আয়রনের একটি দুর্দান্ত উৎস, যদিও গরুর মাংসের এবং ভেড়ার মাংসের চেয়ে এটিতে কম আয়রন থাকে।
শূকরের মাংসের অপকারিতা
শূকরের মাংসের অপকারিতা রয়েছে। উপকারিতার চেয়ে এর অপকারিতা বহু গুণে বেশি। তাই যারা শূকরের মাংস খান তারা শূকরের মাংস খাওয়ার আগে দশবার ভেবে নিবেন। শূকরের মাংসের অপকারিতা গুলো হল –
ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রক্রিয়াজাত মাংস ক্যান্সারের কারণ হতে পারে। গবেষকরা দেখেছেন যে, প্রতিদিন ৫০ গ্রাম শূকরের প্রক্রিয়াজাত মাংস খাওয়া আপনার কোলোরেক্টার ক্যান্সারের ঝুঁকি ১৮% বাড়িয়ে দেয়।
শূকরের মাংসে পরজীবী থাকে : আপনি কি জানেন শূকর তাদের শরীরে এবং মাংসে বিভিন্ন ধরনের পরজীবী বহন করে? এইসব পরজীবীদের মধ্যে কিছু পরজীবী রান্না করার সময়ও মেরে ফেলা যায় না। আবার কম রান্না করা শূকরের মাংসে ট্রাইচিনেলা কৃমির লার্ভা থাকে।
আরও পড়ুন নুডুলস খাওয়ার উপকারিতা ও ক্ষতিকর দিক
সংক্রমিত শূকরের মাংস খাওয়ার প্রায় এক সপ্তাহ পর আপনার শরীরের ভেতরে প্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রী কৃমি গুলো লার্ভা তৈরি করে, যা আপনার রক্ত প্রবাহে প্রবেশ করে এবং অবশেষে পেশি বা অন্যান্য টিস্যুতে প্রবেশ করে। একবার এইসব টিস্যুতে আক্রমণ ঘটলে ট্রাইচিনোসিসের মতো গুরুতর অসুস্থতার লক্ষণ সমূহ দেখা দেয়। এই লক্ষণগুলো হল :
- মাথাব্যথা
- মাত্রাতিরিক্ত জ্বর
- সাধারণ দুর্বলতা
- পেশিতে ব্যথা
- চোখ গোলাপি হওয়া
- চোখের পাতা ফুলে যাওয়া
শূকর ভাইরাস বহন করে : শূকর তাদের সাথে অনেক ভাইরাস এবং পরজীবী বহন করে। যারা শূকরের সংস্পর্শে থাকে এবং মাংস ভক্ষণ করে, তাদের ভাইরাস ঘটিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
শূকর হেপাটাইটিস-ই ভাইরাস, নিপাহ ভাইরাস, মেনাঙ্গেল ভাইরাস, paramyxoviridae পরিবারের ভাইরাস সহ আরও বিভিন্ন ভাইরাস বহন করে। এই ভাইরাস গুলি শূকরের মাংস খাওয়ার মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করতে পারে এবং মৃত্যুর ঝুঁকিতেও ফেলতে পারে।
ঔষধের প্রতিক্রিয়া : শূকরকে দ্রুত মোটা তাজা করার জন্য বিভিন্ন ঔষধ খাওয়ানো হয়। এসব ওষুধ খেলে শূকরের অপ্রাকৃতিক ভাবে ওজন বৃদ্ধি হয় এবং অনেক সময় পঙ্গু হয়ে যায়। এইসব শূকরের মাংস খেলে বিভিন্ন স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারেন।
ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ : শূকরের মাংসে বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া থাকে। খামারে রাখা শূকরদের মধ্যে ৭০% শূকরদের নিউমোনিয়া হয়ে থাকে। ২০১৩ সালে এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, শূকরের মাংসের চপে ইয়ারসিনিয়া এন্টারোকোলিটিকা নামক ব্যাকটেরিয়ার ব্যাপক উপস্থিতি পাওয়া যায়।
এই ব্যাকটেরিয়া বছরে প্রায় ১ লাখ আমেরিকানকে সংক্রামিত করে। বিশেষ করে শিশুদের, এ ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হলে জ্বর, ডায়রিয়া এবং পেটে ব্যথা হতে পারে।
শূকরের মাংস হারাম কেন
ইসলামে শূকরের মাংস হারাম করা হয়েছে। শুধু ইসলামেই নয় ইহুদি এবং খ্রিস্টান ধর্মের কিতাব অনুযায়ী শূকরের মাংস খাওয়াও হারাম। এসব ধর্মের মানুষ শূকরের মাংস খেতে পারে না, এটি হারাম হওয়ার কারণে।
আরও পড়ুন হাঁসের ডিমের উপকারিতা ও অপকারিতা
মহান আল্লাহ তাআলা পাক পবিত্র বস্তুকে হালাল এবং অপবিত্র বস্তুকে হালাল ঘোষণা করেছেন। কোরআনে সূরা বাকারার ১৭৩ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ তাআলা শূকরের মাংস হারাম ঘোষণা করেছেন। কেননা এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং বিভিন্ন রোগের কারণ হতে পারে। শূকরের মাংসের অনেক অপকারিতা বা ক্ষতিকর দিক রয়েছে। এজন্য শূকরের মাংস হারাম।
শূকরের মাংস চেনার উপায়
শূকরের মাংস চেনার কিছু উপায় রয়েছে। যেমন :
- রঙ : শূকরের মাংস সাধারণত হালকা গোলাপি রঙের হয়। যেখানে গরুর মাংস গাঢ় লাল হয়।
- নরম : শূকরের মাংস অনেক নরম হয়, তাই সহজেই প্রসারিত করা যায়।
- চর্বি : শূকরের মাংসে অতিরিক্ত পরিমাণে চর্বি পাওয়া যায়। এবং চর্বিগুলোতে ভেজা-ভাব থাকে।
- গন্ধ : শূকরের মাংসের একটি আলাদা সুগন্ধ রয়েছে।
- শূকরের মাংসে আন্ত:মাসকুলার ফ্যাটের পাতলা সাদা রেখা থাকে।
- স্বাদ : শূকরের মাংস চর্বিযুক্ত এবং নোনতা স্বাদের সাথে হালকা মিষ্টির স্পর্শ রয়েছে।
হিন্দুরা কি শূকরের মাংস খায়
সাধারণত বাংলাদেশের হিন্দুরা শূকরের মাংস খায় না। তবে কোন কোন এলাকায় খায় বলে শুনা গিয়েছে। তবে হিন্দু ধর্মেও শূকরের মাংস খাওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তাই বেশিরভাগ হিন্দু শূকরের মাংস খায় না।
শূকর সৃষ্টির ইতিহাস
এখন আপনাকে শূকর সৃষ্টির ইতিহাস সম্পর্কে বলব। শূকর সৃষ্টি হয় হযরত নূহ আলাইহিস সালামের জামানায়। সে সময় পৃথিবীর ঐতিহাসিক মহা প্লাবন সৃষ্টি হয়েছিল। তখন নূহ (আ:) একটি বিশাল নৌকা তৈরি করে তার সঙ্গী সাথী এবং প্রত্যেক জীবজন্তুর এক জোড়া করে প্রাণী নৌকায় উঠালেন। তারপর বিশাল মহাপ্লাবন শুরু হল।
পৃথিবীর সকল কিছু এমনকি পাহাড়ও তখন পানিতে ডুবে গিয়েছিল। নৌকা থেকে নামার কোন অবস্থায় ছিল না তাই সকল পশু পাখিরা জাহাজের মধ্যেই প্রসাব পায়খানা করতে থাকে। কিছু দিন যাওয়ার পর প্রসাব পায়খানার দুর্গন্ধ মানুষের দম বন্ধ হওয়ার অবস্থা হল। তারপর নূহ (আ:) আল্লাহর নিকট দোয়া চাইলেন।
আল্লাহ তাআলা নির্দেশ দিলেন হাতির মাথায় হাত বুলাতে। নূহ (আ:) সেটাই করলেন, তারপর হাতির নাক দিয়ে একজোড়া শূকরের জন্ম হল। এই শূকর গুলো পশু পাখির সব মলমূত্র খেয়ে সাফ করে ফেলল। তারপর সেই নৌকাটি বসবাসের উপযুক্ত হল। এভাবেই শূকরের সৃষ্টি হয়েছিল।
উপসংহার : শূকরের মাংসের অপকারিতা ও উপকারিতা – শূকরের মাংস হারাম কেন
আমাদের সৃষ্টিকর্তা বিভিন্ন প্রয়োজনীয় কারণে বিভিন্ন প্রাণীর সৃষ্টি করেছেন। কিছু প্রাণীর মাংস খাওয়া হারাম এবং কিছু প্রাণীর মাংস খাওয়া হালাল ঘোষণা করেছেন। যেসব প্রাণী পবিত্র এবং এর মাংস খাওয়াও স্বাস্থ্যসম্মত সেসব প্রাণীর মাংস খাওয়াই হালাল। যেমন গরু, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা, উট, হরিণ ইত্যাদি।
কিন্তু কিছু প্রাণী রয়েছে যা অপবিত্র এবং এদের মাংস খেলে মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে এমন প্রাণীর মাংস আমাদের জন্য নিষিদ্ধ। যেমন শূকরের মাংস। শূকরের মাংসের সামান্য কিছু উপকারিতা থাকলেও ক্ষতির দিকই বেশি। তাই আমাদের উচিত শূকরের মাংস এড়িয়ে চলা।
শূকরের মাংস খেয়ে থাকলে এবং রোগে আক্রান্ত হলে দ্রুত চিকিৎসা নিতে হবে এবং তওবা (ফিরে আসা) করতে হবে।
সম্মানিত পাঠক আজকে আমরা আপনাকে জানিয়েছি শূকরের মাংসের উপকারিতা, শূকরের মাংসের অপকারিতা, শূকরের মাংস হারাম কেন, হিন্দুরা কি শূকরের মাংস খায়, শূকরের মাংস চেনার উপায় এবং শূকর সৃষ্টির ইতিহাস সম্পর্কে। অবশ্যই এই পোস্টটি শেয়ার করবেন। ধন্যবাদ