যাকাত হিসাব করার নিয়ম ২০২৪ – কোন কোন সম্পদের উপর যাকাত ফরজ

রোজার বৈজ্ঞানিক উপকার জানুনসম্মানিত পাঠক, আপনি হয়তো কোন কোন সম্পদের উপর যাকাত ফরজ, যাকাত কাদের দেয়া যাবে, যাকাত হিসাব করার নিয়ম ২০২৪, যেসব সম্পদে যাকাত আসে না, দারিদ্র্য দূরীকরণে যাকাত অথবা আপনি যাকাত সম্পর্কে খুঁটিনাটি সকল বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চান। তাহলে এই আর্টিকেলটি মনোযোগ সহকারে শেষ পর্যন্ত পড়ুন।
যাকাত হিসাব করার নিয়ম ২০২৪
এছাড়াও আমরা এখানে আলোচনা করব যাকাত দেওয়ার ফজিলত কোন সম্পদের কি পরিমাণ যাকাত দিতে হবে ও যাকাত না দেয়ার শাস্তি, যাকাত ও ইনকাম ট্যাক্সের মধ্যে পার্থক্য এবং আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরব যা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য জানা আবশ্যক।

ভূমিকা

ইসলামের স্তম্ভ পাঁচটি তার মধ্যে যাকাত অন্যতম। যাকাত এমন একটি মৌলিক বিষয় যার সরাসরি অর্থনৈতিক প্রয়োগ আছে। যাকাত পার্থিব সম্পদের প্রতি আকর্ষণ দুর্বল করে ও ঈমান দৃঢ় করে। আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন- নামাজ আদায় কর ও যাকাত প্রদান কর। (সূরা বাকারা : ৪৩)
আরও ইরশাদ করেন, অথচ তাদেরকে এমন নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তারা আল্লাহর ইবাদত এমনভাবে করবে যাতে তা একনিষ্ঠ হয়ে আল্লাহর জন্য নির্ধারিত হয়ে যায়। আর তারা নিয়মিতভাবে নামাজ আদায় করবে ও যাকাত আদায় করবে। এটিই হচ্ছে সঠিক দ্বীন। (সূরা বাইয়িনাহ : ৫) তাই আমাদের জানতে হবে কোন কোন সম্পদের উপর যাকাত ফরজ।

কোন কোন সম্পদের উপর যাকাত ফরজ

কোন কোন সম্পদের উপর যাকাত ফরজ তা নিম্নে দেওয়া হলো-

  • সোনা, রূপা, (বার, গহনা যাই হোক না কেন) নিত্য ব্যবহার্য হলেও যাকাত দিতে হবে (যেমন ঘড়ি, চশমা, বাঁধানো দাঁত ইত্যাদি)।
  • নগদ টাকা পয়সা, ব‍্যাংক ব‍্যালেন্স, সিকিউরিটি মানি, ফিক্সড্ ডিপোজিট, শেয়ার, বন্ড ও অন্যান্য ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্ট্রুমেন্টস।
  • ব্যবসার সম্পদ (যা ব্যবসার উদ্দেশ্যে ক্রয়কৃত)।
  • ব্যবসার কাঁচামাল, উৎপাদিত বস্তু বা উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে থাকা বস্তু।
  • যেসব বেসরকারি কোম্পানিতে কর্মচারীদের প্রভিডেন্ট ফাণ্ড একটি পৃথক বোর্ডের নিকট হস্তান্তর করা হয়। আর সে বোর্ডে কর্মচারীদের প্রতিনিধি থাকে তবে এ ধরনের প্রভিডেন্ট ফাণ্ডের উপর যথা নিয়মে যাকাত আসবে। (ফাতাওয়া ও মাসাইল)।
চলুন এখন জেনে নিব যাকাত হিসাব করার নিয়ম ২০২৪।

যাকাত হিসাব করার নিয়ম ২০২৪

যাকাত হিসাব করার নিয়ম ২০২৪ – ৭.৫ তোলা স্বর্ণ বা ৫২.৫ তোলা রুপা কিংবা সমমূল্যের সম্পদকে নিসাব বলা হয়। কোন মুসলমান নিত্য প্রয়োজনীয় খরচাদি ব্যতীত এই পরিমাণ মালের মালিক হলে তাকে নিসাবের মালিক বলা হয়। এই নিসাবের উপর বৎসর অতিক্রান্ত হলে যাকাত ওয়াজিব হয়। এ ব্যাপারে সাধারণত যে ভুল বুঝাবুঝি হয়ে থাকে তা হলো, অনেকে মনে করেন প্রতিটি টাকার উপর স্বতন্ত্রভাবে পূর্ণ এক বৎসর অতিক্রান্ত হতে হবে। এই ধারণা ঠিক নয়।
বরং যদি কেউ বছরের শুরুতে একবার নিসাবের মালিক হয়ে যায়; যেমন, রমজানের এক তারিখে যদি কেউ নিসাবের মালিক হয় তবে আগামী বছর যখন পহেলা রমজান আসবে সেই সময়ও যদি এ ব্যক্তি নিসাবের মালিক থাকে তবে এই ব্যক্তির উপর যাকাত ওয়াজিব হবে।
বছরের মাঝপথে যে অর্থ আসা-যাওয়া করেছে (নিসাবের পরিমাণ থেকে কমে না গেলে) তার কোন ধর্তব‍্য নেই। অতএব, যাকাত আদায়ের দিন দেখতে হবে যে, আপনার কাছে কত টাকার স্থিতি আছে। পুরো টাকার উপরই যাকাত দিতে হবে।
এর মধ্যে কিছু টাকা যদি একদিন আগে এসে থাকে তারও যাকাত দিতে হবে। অবশ্য বছরের মাঝে যদি তার সমস্ত মাল নষ্ট বা খরচ হয়ে যায় তবে নিসাব বাতিল হয়ে যাবে। পুনরায় নিসাবের মালিক হলে নতুন করে হিসাব শুরু হবে। আশাকরি বুঝতে পেরেছেন যাকাত হিসাব করার নিয়ম ২০২৪।

কোন সম্পদের কি পরিমাণ যাকাত দিতে হবে

কোন সম্পদের কি পরিমাণ যাকাত দিতে হবে তা নিচে দেওয়া হলো –
  • গুপ্তধন বা খনিতে প্রাপ্ত সম্পদের এক পঞ্চমাংশ অর্থাৎ ২০% যাকাত দিতে হবে।
  • কিছু সম্পদ আছে যেমন, জমিন চাষ করি আমরা, বীজ ফেলি আমরা, কিন্তু আকাশ থেকে পানি দেন আল্লাহ অর্থাৎ বৃষ্টির পানিতে ফসল হলে এটার যাকাত দিতে হবে ১০%। যেটাকে বলে ওরশ।
  • আবার কিছু সম্পদ আছে, জমিন চাষ করি আমরা, বীজ দেই আমরা, পানিও দেই আমরা, সব করি আমরা, এখানে পরিশ্রম ও খরচ দুটোই বেশি হয়। তাই এখানে আমাদের যাকাত দিতে হবে ৫%। যেমন ইরি ধানের আবাদ।
  • দিনরাত চিন্তা ও পরিশ্রম করে যারা সম্পদ উপার্জন করে তারা তাদের সম্পত্তির ৪০ ভাগের ১ ভাগ যাকাত দিতে হবে। অর্থাৎ প্রতি একশত টাকায় আড়াই টাকা (২.৫%)। যেমন – ব‍্যবসা।
  • স্বর্ণ, রূপা, অন্যান্য সম্পদ, নগদ অর্থের চলতি বাজার মূল্য ধরতে হবে। পুরাতন দর বা ক্রয় মূল্য ধর্তব্য নয়। অলংকার এর সাথে খাঁদ মিশ্রিত থাকলে এবং স্বর্ণের তুলনায় খাঁদের পরিমাণ কম হলে পুরোটাই স্বর্ণ হিসেবে ধরা হবে।
  • যাকাতের ক্ষেত্রে নিয়ত করা আবশ্যক। সেটা প্রদান করার সময়ও হতে পারে কিংবা পূর্বেও হতে পারে, কিন্তু পরে নয়।
  • জমির বায়নার টাকার যাকাত বিক্রেতা আদায় করবে; ক্রেতা নয়।
  • ব্যবসার উদ্দেশ্যে স্টক করা যাবতীয় পণ্য দ্রব্যের যাকাত আদায় কালে পাইকারি দরের হিসাব করা যাবে। তবে বিজ্ঞ উলামায়ে কেরামের মতে সর্তকতা স্বরূপ বিক্রয় মূল্য হিসাব করা উত্তম। আপনি হয়তো বুঝতে পেরেছেন কোন সম্পদের কি পরিমাণ যাকাত দিতে হবে।
See also  পোশাকে প্রাণীর ছবি থাকলে নামাজ হবে কি - মৃত ব্যক্তির ছবি ঘরে রাখা যাবে কি

যাকাত কাদের দেয়া যাবে

সূরা তাওবাতে আল্লাহ তা’আলা যাকাত কাদের দেয়া যাবে সে সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন।
  • ফকীর: যার কিছু সম্পদ আছে তবে নিসাব পরিমাণ নেই, কারো কাছে অভাব প্রকাশ করে না। অথচ সে নিজ প্রয়োজনাদী পূরণে অক্ষম।
  • মিসকিন: যার কোন সম্পদ নেই। মানুষের দয়া দাক্ষিণ‍্যে চলতে হয়।
  • যাকাত ব্যবস্থাপনা অর্থাৎ সংগ্রহ ও বিতরণে নিযুক্ত কর্মচারীগণের বেতন ভাতা (এই হুকুম কেবলমাত্র ইসলামী শাসনব্যবস্থা কায়েম হলে প্রযোজ্য)।
  • মন জয় করার জন্য: ইসলাম কবুল করবে এমন লোকদের মন জয় করার জন্য (বর্তমানে এর প্রচলন নেই)। নও মুসলিমদের সমস্যা দূর করার জন্য। এমনকি তারা ধনী হলেও।
  • দাস মুক্তি: মুক্তিপণ ধার্যকৃত দাস (বর্তমানে এর প্রচলন নেই)।
  • ঋণগ্রস্তের ঋণ পরিশোধ।
  • আল্লাহর পথে ব্যয়: যেসব মুজাহিদ যারা আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করে কিন্তু যুদ্ধের উপকরণ ক্রয়ের সামর্থ্য নেই অথবা দ্বীনের প্রচার প্রসারে নিয়োজিত ব্যক্তি।
  • মুসাফির, প্রবাসী লোক, বাড়িতে সে যতই ধনী হোক না কেন প্রবাসে সে যদি সমস্যায় পড়ে তবে যাকাত দ্বারা তাকে সাহায্য করা যাবে।
  • যদি কোন প্রতিষ্ঠান অসহায় অভাবীদের সেবায় নিয়োজিত থাকে তবে তাদের মাধ্যমে যাকাত ব্যবস্থাপনা করা জায়েজ আছে। যেমন : মাদরাসা, এতিমখানা, সেবা সংস্থা, ট্রাস্ট ইত্যাদি। তবে উপযুক্ত ব্যক্তিদের হাতে পৌঁছালো কিনা এদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। কিন্তু মাদরাসা, মসজিদ বা অন্য কোন জনহিতকর কাজে, অথবা মসজিদ-মাদরাসায় কোরআন শরীফ বা কিতাবাদী ক্রয়ে অথবা রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক কোন সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা ব্যয় খাতে যাকাতের টাকা দান করা যাবে না। এছাড়াও ঔরসজাত সম্পর্ক, যেমন – ছেলে মেয়ে, পিতা পুত্র, দাদা নাতি, ইত্যাদি এবং বৈবাহিক সম্পর্ক যেমন : স্বামী স্ত্রীকে, স্ত্রী স্বামীকে যাকাত দিতে পারবে না।
  • অমুসলিমদের যাকাত দেয়া জায়েজ নেই।
  • যাকাত প্রদানের ক্ষেত্রে নিজের আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীগণ অগ্রাধিকার পাবে।
যাকাত কাদের দেয়া যাবে তা আমরা বুঝলাম, কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, যাকাতের মাল নিজের সম্পত্তি থেকে আলাদা করে দান করে দিলেই যাকাত আদায় হবে না। বরং উক্ত মাল যোগ্য প্রাপকের হাতে পৌঁছলে তবেই যাকাত আদায় হবে।

যাকাত দেওয়ার ফজিলত

যাকাত দেওয়ার ফজিলত গুলো হলো-
  • গরীবের প্রয়োজন পূর্ণ করে, অভিশপ্ত পুঁজিতন্ত্রের মূলোৎপাটন করে, সম্পদ কুক্ষিগত করার মানসিকতা দূর করে সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্যতা সৃষ্টি করে।
  • মুসলমানদের সামগ্রিক শক্তি বৃদ্ধি করে। দারিদ্রতা বিমোচনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে সহায়তা করে।
  • বান্দা ও আল্লাহর মধ্যে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়। যার ফলে বান্দাকে আল্লাহ তাআলা দ্বীনি ক্ষেত্রে উন্নতি দান করেন। বালা মুসিবত থেকে হেফাজত করেন।
  • চুরি-ডাকাতি-ছিনতাইসহ সব ধরনের অভাবজনিত অপরাধের মূলোৎপাটন করে। ধনী-গরীবের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে।
  • সম্পদের বরকত ও কার্যকারিতা বৃদ্ধি হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন – যাকাতে সম্পদ কমে না। (মুসলিম, তিরমিযী)।
যাকাত দেওয়ার ফজিলত অনেক, কিন্তু গরীবের হক বলে নয় বরং নিজের মালের ময়লা দূর করার জন্যই যাকাত দেয়া অপরিহার্য। সুতরাং যাকাত দেয়া মানে গরিবদের প্রতি করুণা করা নয়, বরং নিজেকে দায়মুক্ত করা। আল্লাহ তাআলা কোরআনে ইরশাদ করেন – তাদের সম্পদ থেকে সদকা (যাকাত) গ্রহণ করো; যেন তুমি সেগুলোকে এর মাধ্যমে পবিত্র ও বরকতময় করতে পারো। (সূরা তাওবা : ১০৩)

দারিদ্র্য দূরীকরণে যাকাত

দারিদ্র্য দূরীকরণে যাকাত এর ভূমিকা বিশ্লেষণে দারিদ্র্যের মাত্রা ও কারণ অনুধাবন প্রয়োজন। দারিদ্র একটি জটিল প্রত্যয়, এটি ব‍্যাষ্টিক ও সামষ্টিক উভয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অধ‍্যয়ন করা দরকার। সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি-পলিসি, সার্বিক প্রবৃদ্ধি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, আয়ের সুষম বণ্টন ইত‍্যাদিকে প্রভাবিত করে এবং এসব বিষয় সার্বিক দারিদ্রতার মাত্রা নির্ধারণ করে।
ব‍্যাষ্টিক পর্যায়ে ব্যক্তিদের আয়ের উৎসের বিভিন্নতার সাথে দারিদ্র্য সম্পর্কযুক্ত। সম্পদ ও সুযোগের পূর্ণ বণ্টন, সামর্থ্য তৈরি, সম্পদ সৃষ্টি এবং আয়ের সুযোগ তৈরি ইত্যাদি নীতি পলিসির ক্ষেত্রে যাকাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আয়ের সাপোর্ট দেয়া প্রধানত তাদের ক্ষেত্রে যারা শারীরিক বা মানসিক অসমর্থ হওয়ার কারণে আয় করতে পারে না।

বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ। বিশেষজ্ঞদের মতে বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা যাকাত আসে। এই প্রাক্কলিত হিসাব অনুমান নির্ভর। যদি ঠিকভাবে মুসলমানদের উদ্বুদ্ধ করা যায় তাহলে এর পরিমাণ আরও বাড়বে। কিন্তু ব্যবস্থাপনা না থাকায় এই বিশাল অর্থ পুরোপুরি সংগ্রহ হয় না।
অধিকাংশ যাকাতই নিজ উদ্যোগে দেয়া হচ্ছে। অনেকে অসম্পূর্ণ দিচ্ছেন। কেউবা একেবারেই দিচ্ছেন না। এই পরিমাণ অর্থ যদি প্রাতিষ্ঠানিক বা রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সংগ্রহ এবং পরিকল্পিতভাবে ব্যয় হয় তবে অচিরেই বাংলাদেশে দারিদ্র্য দূরীকরণ সম্ভব।

যাকাত না দেয়ার শাস্তি

যাকাত না দেয়ার শাস্তি অনেক ভয়াবহ। যাকাত আদায় না করলে যাকাত না দেয়ার শাস্তি ভোগ করতে হবে। যেমন আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন – আর যারা স্বর্ণ ও রূপা জমা রাখে এবং তা ব্যায় করে না আল্লাহর পথে, তাদের কঠোর আযাবের সুসংবাদ (ব‍্যঙ্গার্থে) শুনিয়ে দিন। সেদিন জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করা হবে এবং (টাকা পয়সা, স্বর্ণ রৌপ‍্যদ্বারা) তাদের কপাল, পার্শ্ব ও পৃষ্ঠদেশ দগ্ধ করা হবে এবং বলা হবে যে, নিজেদের জন্য যেটা সঞ্চয় করে রেখেছিলে এটাই তো তাই। এখন তোমাদের সঞ্চয়ের সাধ আস্বাদন করে দেখ। (সূরা তাওবা : ৩৪-৩৫)

আল্লাহ তাআলা আরও এরশাদ করেন – প্রত্যেক পশ্চাতে সম্মুখে পরনিন্দাকারীর দুর্ভোগ, যে অর্থ সঞ্চিত করে ও গণনা করে। সে মনে করে যে, তার অর্থ চিরকাল তার সাথে থাকবে। কখনও না। সে অবশ্যই নিক্ষিপ্ত হবে পিষ্ঠকারীর মধ্যে। আপনি কি জানেন পিষ্ঠকারী কি? এটা আল্লাহর প্রজ্জ্বলিত আগুন যা হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছবে। এতে তাদেরকে বেঁধে দেয়া হবে লম্বালম্বি খুঁটিতে। (সূরা হুমাযাহ : ১-৯)

হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যাকে আল্লাহ ধন-সম্পদ দান করেছেন, আর সে তার যাকাত দেয় না, কিয়ামতের দিন তার মালকে তার জন্য মাথায় টাক পড়া (ভয়ানক আকৃতি) সাপের রূপ দেয়া হবে যার চক্ষুর উপর দুটি কালো দাগ থাকবে (অর্থ‍াৎ প্রচণ্ড বিষাক্ত হবে) ঐ সাপকে তার গলায় বেড়ি স্বরূপ লাগিয়ে দেয়া হবে। সেটা তার মুখের দিক থেকে দংশন করতে থাকবে আর বলতে থাকবে আমিই তোমার সম্পদ। আমিই তোমার সঞ্চয় করে রাখা মাল। (বুখারী) আমরা জানলাম যাকাত না দেয়ার শাস্তি।

যেসব সম্পদে যাকাত আসে না

যেসব সম্পদে যাকাত আসে না তা নিম্নরূপ-
  • অল্প দিনেই যেসব শস্য নষ্ট হয়ে যায় তার উপর যাকাত ফরজ হয় না।
  • যেসব বস্তু উৎপাদন ও বৃদ্ধি সাধন অসম্ভব তার যাকাত দিতে হয় না।
  • গৃহপালিত পশু, গোশত খাওয়ার জন্য পালিত পশু এবং বন্য পশুর উপর যাকাত নেই। অবশ্য বন্য পশু যদি ব্যবসার মাল হয় তবে যাকাত দিতে হবে।
  • যেসব জিনিস ভাড়ায় খাটানো হয় যেমন – রিকশা, সাইকেল, ট‍্যাক্সি, বাস, ট্রাক, ফার্নিচার, ডেকোরেশন, ক্রোকারিজ অথবা দোকান, বাড়ি ভাড়ার উপর যাকাত নেই। অবশ্য ভাড়া লব্ধ অর্থ যদি নিসাব পরিমাণ হয়ে যায় এবং বছর অতিক্রম করে তাহলে যাকাত দিতে হবে।
  • দাতব‍্য বা সমাজ কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানের সম্পদ যা জনগণের কল্যাণে নিয়োজিত, তার কোন যাকাত নেই।
  • সরকারি কোন সম্পত্তিতেই যাকাত নেই।
  • যদি কারো নিকট পাওনা টাকা থাকে তবে পাওনা টাকার যাকাত দিতে হবে। পাওনা টাকা উসূল করার পর বিগত বৎসরের যাকাত দেয়া যাবে। অথবা উসূল করার পূর্বেই প্রতিবছর নিয়মিত যাকাত দিয়ে দিলেও আদায় হয়ে যাবে। তবে যে পাওনা টাকা ফেরত পাওয়ার কোন আশা নেই সে টাকার যাকাত দিতে হবে না। যদি কখনও সে টাকা উসূল হয় তবে উসূল হওয়ার পর থেকে যাকাত দিতে হবে।
  • যদি কোন নিসাবের মালিক দোকান বা বাড়ি ভাড়া নেয় এবং মালিকের নিকট অ্যাডভান্স হিসেবে অগ্রিম টাকা জমা রাখে তাহলে উক্ত টাকার যাকাত দিতে হবে না।
  • সুদ-ভিত্তিক অর্থনীতি নির্ভর ব্যাংকের ফিক্সড ডিপোজিট, সঞ্চয়পত্র, প্রাইজবন্ড এবং বীমা কোম্পানির শেয়ার বাবদ প্রাপ্ত লাভ সুদ হিসেবে গণ্য বিধায় সরাসরি হারাম ও অবৈধ। হারাম মালের উপর যাকাত আসে না। এ সকল বন্ডের আসল ও মূলধনের উপর যথানিয়মে যাকাত ফরজ হবে। (ফাতাওয়া ও মাসাইল)
  • কারখানার মেশিনারি, শিল্পী ও প্রকৌশলীদের ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি, পরিবারের জন্য সঞ্চিত খাদ্যশস্য, তৈজসপত্র, ইত্যাদির উপর যাকাত আসে না।
See also  ইস্তেঞ্জার সময় কয়টি কাজ করা নিষেধ - টয়লেটের আদব সমূহ
কোন কোন সম্পদের উপর যাকাত ফরজ তা পূর্বে জেনেছি। সরকারি প্রভিডেন্ট ফান্ডের অর্থ সম্পূর্ণভাবে সরকারের কর্তৃত্বে থাকে তাই এতে যাকাত ওয়াজিব হবে না। হাতে আসার পর নিসাব মোতাবেক যাকাত আসবে। যেসব সম্পদে যাকাত আসে না সে সম্পর্কে আশাকরি বুঝতে পেরেছেন।
তবে যদি সরকারি কর্তৃত্বে থাকাকালীন প্রভিডেন্ট ফান্ডের অর্থ দিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মচারী কোন ইন্স‍্যুরেন্স কোম্পানিতে অংশগ্রহণ করে এবং বীমা কোম্পানি তার ফান্ডের কর্তৃত্ব গ্রহণ করে তবে যাকাত ওয়াজিব হবে। (ফাতাওয়া ও মাসাইল) আমরা আজকে জানতে পারলাম যেসব সম্পদে যাকাত আসে না।

যাকাত ও ইনকাম ট্যাক্সের মধ্যে পার্থক্য

যাকাত ও ইনকাম ট্যাক্সের মধ্যে পার্থক্য : যাকাত ও ইনকাম ট্যাক্স (আয়কর) কখনোই এক নয়। ইনকাম ট্যাক্স উপার্জনের উপর সরকারিভাবে ধার্য করা হয়। কিন্তু যাকাত এক বছর জমা টাকার উপর শরীয়ত মোতাবেক ধার্য হয়। যাকাতের ভিত্তি হচ্ছে ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধ এবং যাকাত ব্যয় করা হয় শুধু দরিদ্রদের জন্য।
কিন্তু ইনকাম ট্যাক্সের ভিত্তি হল প্রচলিত সরকারি আইন। এর ব্যয় জনগণের উন্নয়ন খাতে হয় যেখানে ধনী-গরীব সবাই শামিল। সুতরাং ইনকাম ট‍্যাক্সকেই কেউ যদি যাকাত মনে করে তবে তার যাকাত আদায় হবে না।

লেখকের মন্তব্য: যাকাত হিসাব করার নিয়ম ২০২৪

কোন কোন সম্পদের উপর যাকাত ফরজ তা আমরা জেনেছি। প্রত্যেক নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিকদের উপর যাকাত ফরজ। যাকাতের মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলা সম্পদ পবিত্র ও বৃদ্ধি করে দেন। যাকাত না দিলে পরকালে চরম শাস্তি ভোগ করতে হবে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন – কেউ যদি আল্লাহর পুরস্কারের আশায় যাকাত দেয় তাহলে তাকে পুরস্কৃত করা হবে। কিন্তু যে যাকাত দিতে অস্বীকার করবে তার কাছ থেকে শক্তি প্রয়োগ করে যাকাত আদায় করতে হবে এবং আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী তার অর্ধেক সম্পত্তি নিয়ে নেয়া হবে। (বুখারী, নাসাঈ, বায়হাকী)

হযরত আবু বকর (রা.) রাসূল (সা.) এর মৃত্যু পরবর্তী যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আমাকে মানুষের সাথে লড়াই করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে পর্যন্ত না তারা এ কথার সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল, আর যে পর্যন্ত না তারা নামাজ আদায় করে ও যাকাত দেয়।
আর যখন তারা এসব করবে তখন তাদের রক্ত ও সম্পদকে তারা আমার নিকট থেকে হেফাজত করে নিবে এবং তাদের হিসাব নিকাশ হবে আল্লাহর নিকট। (বুখারী ও মুসলিম)

হযরত আবু আইউব (রা.) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি আল্লাহর রাসূলকে বললেন, আমাকে এমন আমলের কথা জানিয়ে দিন যা আমাকে বেহেশতে নিয়ে যাবে। তিনি উত্তর দিলেন – আল্লাহর ইবাদত কর, তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক করো না। নামাজ আদায় কর, যাকাত আদায় কর এবং আত্মীয়দের সাথে সুন্দর ব্যবহার কর। (বুখারী ও মুসলিম)
পাঠক আমরা তাহলে যাকাত হিসাব করার নিয়ম ২০২৪, যেসব সম্পদে যাকাত আসে না, যাকাত ও ইনকাম ট্যাক্সের মধ্যে পার্থক্য, যাকাত না দেয়ার শাস্তি, দারিদ্র্য দূরীকরণে যাকাত এর ভূমিকা, যাকাত দেওয়ার ফজিলত, যাকাত কাদের দেয়া যাবে, কোন সম্পদের কি পরিমাণ যাকাত দিতে হবে, কোন কোন সম্পদের উপর যাকাত ফরজ তা জানালাম।

Leave a Comment