রোজা রাখার বৈজ্ঞানিক উপকারিতাপ্রিয় পাঠক, আপনি নিশ্চয় কি কি কারণে রোজা না রাখা জায়েজ, রোজা সম্পর্কে ১৪টি হাদিস, কি কি কারণে রোজা ভাঙলে কাজা ওয়াজিব হয়, কি কি কারণে রোজা ভাঙলে কাফফারা দিতে হয়, রোজা ভঙ্গের কাফফারা, রোজা মাকরুহ হওয়ার কারণ, যেসব কারণে রোজার কোন ক্ষতি হয় না ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে চান।
এছাড়াও কি কি কারণে রোজা ভেঙে ফেলা জায়েজ, কি কি কারণে রোজা না রাখা জায়েজ, রোজা না রাখার শাস্তি, রোজা সম্পর্কে হাদিস গুলো জানতে চান। এজন্য সম্পূর্ণ এই আর্টিকেলটি পড়ুন।
ভূমিকা
মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের উপর রোজা ফরজ করেছেন মুত্তাকী হওয়ার জন্য। তবে রোজা নিজের ইচ্ছামত পালন করলে মুত্তাকী হওয়া যাবে না। রোজা রাখতে হবে রাসুলের সুন্নাতের তরিকা অনুযায়ী। আর রোজা ভেঙ্গে গেলে বা ইচ্ছাকৃত ভাবে ভেঙ্গে ফেললে করণীয় কি সে সম্পর্কে আমাদের অবশ্যই জানতে হবে। তো চলুন এসব বিষয়ে আলোচনা করা যাক।
কি কি কারণে রোজা ভাঙলে কাজা ওয়াজিব হয়
যে সমস্ত কারণে রোজা ভঙ্গ হলে শুধু কাজা ওয়াজিব হয়। নিম্নে তা তুলে ধরা হলো-
- ইচ্ছাকৃত মুখ ভরে বমি করা।
- রাত্র মনে করে সুবহে সাদিকের পর সাহরী খাওয়া।
- সূর্যাস্ত হয়ে গেছে ধারণা করে সময় হওয়ার পূর্বেই ইফতার করা।
- মাটি বা পাথর জাতীয় অখাদ্য বস্তু গিলে ফেলা।
- রোজা অবস্থায় ভুলে খাওয়ার পর (ভুল করে কিছু খেলে রোজা ভাঙ্গে না) পুনরায় স্বেচ্ছায় কিছু খাওয়া।
- বুট পরিমাণ কোন খাদ্য দাঁত থেকে বের করে গিলে ফেলা।
- রোজার নিয়ত না করা।
- কুলি করার সময় হঠাৎ পানি গলায় চলে যাওয়া।
- কান বা নাক দিয়ে পানি বা ঔষধ গলায় বা মাথায় পৌঁছে গেলে।
- বিড়ি, সিগারেট, আফিম, গাঁজা ইত্যাদি সেবন করলে।
- দাঁত থেকে রক্ত নির্গত হয়ে তা যদি থুথুর চেয়ে বেশি পরিমাণ হয় এবং গলায় চলে যায়।
- এ সমস্ত কারণে রোজা ভঙ্গ হলে শুধু কাজা করতে হবে। কাফফারা দিতে হবে না। তবে রোজাদারের ন্যায় সারাদিন অভুক্ত থাকা ওয়াজিব।
এ সমস্ত কারণে কারণে রোজা ভাঙলে কাজা ওয়াজিব হয়।
কি কি কারণে রোজা ভাঙলে কাফফারা দিতে হয়
যে সমস্ত কারণে কাজা কাফফারা উভয়ই ওয়াজিব হয় –
- ইচ্ছাকৃত-ভাবে স্বামী স্ত্রী মেলামেশা করলে।
- ইচ্ছাকৃত কোন কারণ ছাড়াই পানাহার করে রোজা ভেঙ্গে ফেললে কাফফারা দিতে হয়।
রোজা ভঙ্গের কাফফারা
অকারণে রমজানের রোজা ভেঙ্গে ফেললে (রমজান ব্যতীত অন্য কোন রোজা ভাঙলে শুধু কাজা আদায় করতে হয় কাফফারা আদায় করতে হবে না) একাধারে দুই মাস অর্থাৎ ৬০টি রোজা লাগাতার রাখতে হয়। মাঝখানে বাদ দিলে আবার প্রথম থেকে ৬০টি রাখতে হবে। যদি কারো কাফফারার রোজা রাখার শক্তি না থাকে তবে ৬০ জন পূর্ণ বয়স্ক মিসকিন কে দুই বেলা পেট ভরে খাওয়াতে হবে।
অথবা সদকায়ে ফিতর পরিমাণ টাকা দিতে হবে। একজনকে ৬০ দিন দুই বেলা খাওয়ালেও অসুবিধা নেই। কিন্তু ৬০ দিনের সমস্ত টাকা একজনকে একদিনে দেয়া জায়েজ নেই। এমন করলে শুধুমাত্র একদিনের রোজা ভঙ্গের কাফফারা আদায় হবে। এক রমজানে যদি কয়েকটি রোজা ভাঙ্গে তবে একটি কাফফারাই ওয়াজিব হবে। রোজা ভঙ্গের কাফফারা অবশ্যই আদায় করতে হবে।
রোজা মাকরুহ হওয়ার কারণ
রোজা মাকরুহ হওয়ার কারণ নিম্নে উল্লেখ করা হলো-
- কোন বস্তুর স্বাদ নিলে বা চাবালে। তবে বিশেষ কারণ-বশত করা যাবে। যেমন- কারো স্বামী যদি তরকারিতে ঝাল লবণের হেরফের হলে বকাঝকা করে তবে রোজা অবস্থায় সামান্য ঝোল জিহ্বায় লাগিয়ে পরখ করেই সাথে সাথে ফেলে দিয়ে কুলি করে নিতে হবে।
- পেস্ট দিয়ে ব্রাশ করলে বা দাঁত মাজলে।
- লাগাতার রোজা রাখা অর্থাৎ সাহরি ইফতার কোনটাই না করা।
- গীবত করা।
- মিথ্যা ও ফাহেশা কথা বলা।
- ইচ্ছাকৃত অল্প বমি করলে।
- গড়গড়া করলে। (গলায় পানি চলে গেলে রোজা ভেঙ্গে যাবে)
- আঠা জাতীয় কোন কিছু চিবালে।
- মুখে থুথু জমা করে গিলে ফেললে।
- নাকে পানি দিয়ে ভেতরের দিকে টেনে নিলে। (তালুতে পৌঁছে গেলে রোজা ভেঙ্গে যাবে)
- বারবার কুলি করলে।
- রোজার কারণে খুব বেশি অস্বস্তি বা পেরেশানি প্রকাশ করলে।
- গান বাজনা শুনলে। এসবই হলো রোজা মাকরুহ হওয়ার কারণ সমূহ।
যেসব কারণে রোজার কোন ক্ষতি হয় না
- সুরমা ব্যবহার করলে।
- শরীর বা মাথায় তৈল ব্যবহার করা।
- গোসল করা।
- মিসওয়াক করা।
- আতর ও সুগন্ধি ব্যবহার করা।
- ভুলবশত কোন কিছু খেয়ে ফেললে।
- অনিচ্ছাকৃত বমি করা।
- থুথু গিলে ফেলা।
- অনিচ্ছাবশত মশা-মাছি অথবা ধোঁয়া গলার মধ্যে ঢুকে গেলে।
কি কি কারণে রোজা ভেঙ্গে ফেলা জায়েজ
হঠাৎ কোন রোগে আক্রান্ত হয়ে এমন অবস্থা হয় যে, ঔষধ না খেলে মৃত্যুর আশঙ্কা আছে। এমতাবস্থায় রোজা ভাঙ্গা জায়েজ। তবে পরে কাজা করে নিতে হবে। কাফফারা আদায় করতে হবে না। এমনভাবে গর্ভবতী মহিলার যদি প্রাণনাশের আশঙ্কা দেখা দেয় তখনও রোজা ভাঙতে পারবে।
কি কি কারণে রোজা না রাখা জায়েজ
কেউ যদি এমন রোগাক্রান্ত হয় যে, রোজা রাখার কারণে রোগ বৃদ্ধি পায় অথবা প্রাণনাশের সম্ভাবনা আছে, তবে অভিজ্ঞ, মুসলমান এবং দ্বীনদার চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী রোজা ভাঙতে পারবে বা রোজা থেকে বিরত থাকতে পারবে। সাধারণ ডাক্তারের পরামর্শে বা নিজের ধারণা বশত: রোজা না রাখা জায়েজ নেই।
এমনিভাবে কেউ যদি মুসাফির হয় এমতাবস্থায় যদি রোজা রাখার কারণে কষ্ট পাওয়ার বা দুর্বল হয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে তাহলে রোজা না রাখা জায়েজ হবে। কিন্তু যদি বিশেষ কষ্ট না হয় তবে রোজা রাখাই শ্রেয়, কেননা রোজার ফজিলত অনেক বেশি। এছাড়া যদি কোন মহিলা রোজা রাখার কারণে বাচ্চাকে ঠিকমতো দুধ পান করাতে না পারে তখন রোজা না রাখা বৈধ হবে। আশাকরি জানতে পেরেছেন কি কি কারণে রোজা না রাখা জায়েজ।
রোজা না রাখার শাস্তি
রোজা না রাখার শাস্তি অত্যন্ত ভয়াবহ। হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, কেউ যদি শরয়ী কোন ওজর বা অসুস্থতা না থাকা সত্ত্বেও রমজানের একটি রোজা না রাখে তবে সারা জীবন রোজা রাখলেও তা পূর্ণ হবে না। (আবু দাউদ)
সকল আলেম-ওলামাগণ একমত যে, রোজা অস্বীকারকারী কাফির বলে বিবেচিত হবে যার পরিণাম হবে জাহান্নাম। রোজার মতো গুরুত্বপূর্ণ ফরজ ইবাদত না রাখলে জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করতে হবে। এজন্য আমরা যারা ইমানদার রয়েছি তাদের অবশ্যই রোজা রাখতে হবে। নয়তো পরকালে রোজা না রাখার শাস্তি ভোগ করতে হবে।
রোজা সম্পর্কে ১৪টি হাদিস
নিচে রোজা সম্পর্কে ১৪টি হাদিস তুলে ধরা হলো –
- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজান মাসে সকল কয়েদীকে মুক্তি দিতেন এবং প্রত্যেক প্রার্থীকে দান করতেন। (মিশকাত – হাদিসটি ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত)
- আল্লাহর রাসূল বলেছেন- আমার উম্মতকে মাফ করা হয় রমজানের শেষ রাতে। কারণ কর্মচারীর বেতন দেয়া হয় যখন সে কর্ম শেষ করে। (আহমদ – হাদিসটি আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত)
- রাসূল (সা.) বলেছেন- চাঁদ দেখে রোজা রাখো, চাঁদ দেখে রোজা ভাঙ্গ। যদি মেঘের কারণে চাঁদ গোপন থাকে তাহলে শা’বান মাসকে ৩০ দিন পূর্ণ কর। (বুখারী এ মুসলিম – হাদিসটি আবু হুরায়রা রা. বর্ণনাকারী)
- রাসূল (সা.) বলেছেন- রমজান ঠিক রাখার জন্য তোমরা শা’বানের চাঁদ হিসাব কর। (তিরমিযী)
- রাসৃল (সা.) বলেছেন- সন্দেহের দিন রোজা রাখবে না। (ইবনে মাজাহ, আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ)
- আল্লাহর রাসূল বলেছেন- তোমারা সাহরি খাবে, সাহরিতে বরকত আছে। (বুখারী ও মুসলিম)
- রাসূল (সা.) বলেছেন- মুসলমানদের রোজা ও ইহুদী খ্রিস্টানের রোজার মধ্যে পার্থক্য হলো সাহরি খাওয়া। (মুসলিম)
- রাসূর সা. ইরশাদ করেন- মানুষ কল্যাণের সাথে থাকবে যতকাল তারা ইফতারি শীঘ্র শীঘ্র করবে। (বুখারী ও মুসলিম)
- রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন- যে ফজর হবার পূর্বে রোজা রাখার নিয়ত করেনি তাঁর রোজা হয়নি। (তিরমিযী, নাসাঈ, আবু দাউদ)
- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- যখন তোমাদের কেউ আজান শুনে আর খাবার প্লেট তার হাতে থাকে, সে যেন তা রেখে না দেয় যে যাবত না তা থেকে আপন প্রয়োজন পূর্ণ করে। (আবু দাউদ)
- রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেছেন- যখন তোমাদের কেউ ইফতার করে সে যেন খেজুর দ্বারা ইফতার করে। যদি খেজুর না পায় তবে যেন পানি দ্বারা ইফতার করে। কারণ এটা হলো পবিত্রকারী। (আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ)
- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- হে আবু যর! যখন তুমি মাসের তিন দিন রোজা রাখবে তখন তা মাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখে রাখবে। (তিরমিযী, নাসাঈ)
- আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেন- শীতকালে রোজা একটি বিনা কষ্টের নিয়ামত। (আহমদ, তিরমিযী)
- মহানবী সা. বলেছেন- প্রত্যেক জিনিসের যাকাত আছে এবং শরীরের যাকাত হলো রোজা। (ইবনে মাজাহ)
এ ছিল রোজা সম্পর্কে ১৪টি হাদিস। রোজা সম্পর্কে ১৪টি হাদিস সকলেরই মুখস্থ রাখা উচিত। এছাড়া রোজা সম্পর্কে আরও অনেক হাদিস রয়েছে।
কি কি কারণে রোজা না রাখা জায়েজ – রোজা সম্পর্কে ১৪টি হাদিস – লেখকের মন্তব্য
রোজা দ্বারা মুসলমানদের সংযম সাধনা, আত্মশুদ্ধি, সাম্য, সহানুভূতি ও মানবীয় সৎ গুণাবলী সৃষ্টি করাই আল্লাহর পাকের আসল উদ্দেশ্য। তাই আমাদের নিয়ম কানুন মেনে সঠিকভাবে রোজা পালন করতে হবে।
সম্মানিত পাঠক আজকে আমরা জানতে পারলাম কি কি কারণে রোজা ভাঙলে কাজা ওয়াজিব হয়, কি কি কারণে রোজা ভাঙলে কাফফারা দিতে হয়, রোজা ভঙ্গের কাফফারা, রোজা মাকরুহ হওয়ার কারণ গুলো, যেসব কারণে রোজার কোন ক্ষতি হয় না, কি কি কারণে রোজা ভেঙ্গে ফেলা জায়েজ, কি কি কারণে রোজা না রাখা জায়েজ, রোজা না রাখার শাস্তি এবং রোজা সম্পর্কে ১৪টি হাদিস সম্পর্কে। এই আর্টিকেলটি অবশ্যই অন্যদের সাথে নিচের লিংকের মাধ্যমে শেয়ার করবেন।