পায়খানা ক্লিয়ার করার উপায় জানুনসম্মানিত পাঠক, আপনি কলেরা রোগ কিভাবে ছড়ায়, কলেরা রোগের লক্ষণ, কলেরা রোগের চিকিৎসা সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য শেষ পর্যন্ত পড়ুন।
এখানে আমরা আরও আলোচনা করব কলেরা রোগ সনাক্তকরণ, কলেরা রোগের প্রতিরোধ সম্পর্কে।
ভূমিকা
কলেরা একটি পানিবাহিত আন্ত্রিক রোগ। ভারতীয় উপমহাদেশেই এ রোগের প্রকোপ বেশি পরিলক্ষিত হয়। কখনও কখনও এ রোগ মহামারীর আকারও ধারণ করেছে। একসময় এশিয়ার অন্যান্য দেশ এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে কলেরা রোগ মহামারী আকারে দেখা যেত। চিকিৎসা করা না হলে সে সময় এই কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রায় ৫০% মানুষ মারা যেত। এমনকি চিকিৎসা করলেও ১% মানুষ মারা যেত।
জার্মান বিজ্ঞানী রবার্ট কক ১৮৮১ সালে সর্বপ্রথম কলেরা রোগের জীবাণু আবিষ্কার করেন। হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী কলেরা একটি অত্যন্ত প্রাচীন রোগ। সংস্কৃতে কলেরা রোগকে বিশুচিকা বলা হয়ে থাকে। যার অর্থ দাঁড়ায় অন্ত্রের অস্বাভাবিক চলন। বাংলাদেশে স্থানীয়ভাবে কলেরা রোগের নাম ওলাউঠা যার অর্থ হচ্ছে ঘন ঘন পায়খানা বমি করা (ola = act of desending purging, uta = act of ascending vomiting)।
কলেরা রোগের জীবাণুর নাম কি
কলেরা রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু হচ্ছে ব্যাকটেরিয়া যার নাম ভিব্রিও কলেরা (Vibrio cholerae)। বর্তমানে কলেরা জীবাণু Vibrio cholera-এর আরও অন্যান্য সেরোগ্রুপ আবিষ্কৃত হয়েছে। এ ব্যাকটেরিয়া মানুষের অন্ত্রে বসবাস করে। জলজ পরিবেশেও এ ব্যাকটেরিয়া পাওয়া যায়। এছাড়া মুক্ত-জীবী হিসেবেও প্রকৃতিতে থাকতে পারে।
এটি বক্র দণ্ডাকৃতির ব্যাকটেরিয়া। এরা দেখতে অনেকটা ইংরেজি ‘কমা’ আকৃতির হয়ে থাকে। এদের দেহের সরু প্রান্তে (মাথায়) একটিমাত্র ফ্লাজেলা থাকে। তাই এরা সচল। এরা জলজ মাধ্যমে প্রচণ্ড বেগে ছুটাছুটি করতে পারে।
কলেরা রোগ কিভাবে ছড়ায়
- ব্রিটিশ এনেস্থেসিওলজিষ্ট জন স্নো (John Snow) ১৮৫৪ সালে এক গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করেন কলেরা রোগ প্রধানত পানির মাধ্যমে বিস্তার লাভ করে থাকে।
- এছাড়া কলেরা রোগের জীবাণু বাহক রোগীর মল, দূষিত পানি এবং খাদ্য দ্রব্যের মাধ্যমে প্রাথমিক সংক্রমণ ঘটায়।
- কলেরা রোগের ভেদ-বমি দ্বারা দূষিত বিছানা পত্র, পানীয় ও খাদ্য এবং মাছি দ্বারা রোগের গৌণ সংক্রমণ ঘটে।
কলেরা রোগের লক্ষণ
Vibrio cholerae নামক জীবাণু মানুষের অন্ত্রে প্রবেশের পর সেখানে কলেরাজেন (choleragen) নামক এক প্রকার বহিঃবিষ (Exotoxin) নিঃসৃত করে। ফলে মারাত্মক ডায়রিয়ার সৃষ্টি হয়। নিচে কলেরা রোগের লক্ষণগুলো উল্লেখ করা হল-
- পায়খানার সাথে প্রথমদিকে মল থাকলেও পরবর্তীতে ক্রমাগত ঠিক চাল ধোয়া পানির মত পাতলা পায়খানা শুরু হওয়া।
- ক্রমাগত বমি হওয়া এবং উক্ পাড়া। ফলে দেহে পানির স্বল্পতা দেখা দিতে থাকে।
- রোগীর শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায় রোগীর অস্থিরতা প্রকাশ পায়। প্রচণ্ড পিপাসা পায় এবং ঘন ঘন পানি পান করতে থাকে।
- পেটের মাংস পেশীতে খিল ধরে আসে, হাত পায়ে টান ধরে, খিঁচুনি হয়।
- রক্তে পানির পরিমাণ কমে যাওয়ায় রক্ত ঘন হয়ে যায় ও রক্তে অম্লতা বেড়ে যায়। ফলে নিম্ন রক্তচাপের সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে পেশাব বন্ধ হয়ে যায়।
- এ অবস্থায় রোগী শরীর থেকে প্রায় ১০ – ২০ লিটার তরল হারাতে পারে। চোখের চারপাশে ধূসর দাগ পড়ে। চোখ কোঠরে ঢুকে যায় এবং মুখমণ্ডল অস্বাভাবিক মলিন দেখায়।
- রোগীর শরীরের চামড়া শুষ্ক হয়ে ওঠে ও কুঁচকিয়ে যায় (ঢিলা হয়) ও শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যায়।
- শরীরে খনিজ পদার্থের অভাব দেখা দেয়। বিশেষ করে সোডিয়াম আয়নের ঘাটতি দেখা দেয়। এ অবস্থায় রোগী ইলেক্ট্রোলাইট ব্যালেন্স হারানোর ফলে রক্তে প্রোটিনের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় রোগী শকের (Shock) দিকে অগ্রসর হয় ( অজ্ঞান হওয়ার )।
- রোগের চূড়ান্ত পর্যায়ে রোগীর রক্ত সংবহনতন্ত্র বন্ধ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে পারে।
কলেরা রোগ সনাক্তকরণ
- রোগের উপযুক্ত উপসর্গসমূহ এবং রোগীর দেহে তার লক্ষণসমূহ পর্যবেক্ষণ করে ডায়রিয়া-জনিত রোগ হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়।
- রোগের মল (rice water sample)-এর নমুনা গবেষণাগারে পরীক্ষা করে রোগের জীবাণু সনাক্তকরণের মাধ্যমেই কলেরা রোগ নির্ণয় করা হয়ে থাকে।
- অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে সরাসরি চাল ধোয়া পানির মতো মলের নমুনার Hanging drop-এর মাধ্যমে কলেরার ব্যাকটেরিয়া চিহ্নিত করা সম্ভব।
- উপযুক্ত কৃমির আবাদ মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়ার কলোনি ও কোষ পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া।
কলেরা রোগের চিকিৎসা
রোগের উপসর্গ দেখা দেয়ার সাথে সাথে কাল বিলম্ব না করে তরল, লবণ এবং বাইকার্বনেটের ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে রোগীকে যথা-শীঘ্র সম্ভব পরিমিত পরিমাণ লবণ, চিনি ও পানি দিয়ে স্যালাইন তৈরি করে খাওয়াতে হবে। বর্তমানে বাজারে তৈরি স্যালাইনের প্যাকেট সহজলভ্য তাই ঝটপট প্যাকেটের স্যালাইন ব্যবহার করাই শ্রেয়।
আরও পড়ুন হার্ট অ্যাটাক থেকে বাঁচার উপায়
উপরোক্ত খাবার স্যালাইন ব্যতীত বর্তমানে সহজলভ্য নিম্নলিখিত স্যালাইনসমূহ ব্যবহার করলেও কলেরা রোগের চিকিৎসা হিসেবে সুফল পাওয়া যায়।
- বাইকার্বনেটযুক্ত ওরস্যালাইন
- সাইট্রিক এসিডযুক্ত ওরস্যালাইন
- চাউলের গুঁড়াযুক্ত ওরস্যালাইন
- লবণ গুড় দ্রবণ প্রমুখ কর্তৃক প্রদেয় অসম্পূর্ণ স্যালাইন এবং
- সুপার ওরস্যালাইন প্রভৃতি।
- রোগীর অবস্থা বুঝে মুখে আবার স্যালাইনের পরিবর্তে জরুরি শিরার মাধ্যমে স্যালাইন জাতীয় তরল প্রয়োগ করা যেতে পারে। বর্তমানে অনেক প্রকার পলিইলেকট্রোলাইট ফ্লুয়িড বাজারে সহজেই পাওয়া যায়। যেমন- ঢাকা ফ্লুয়িড, ডিটিএস হার্টম্যান ফ্লুয়িড প্রভৃতি। তবে যে কোন স্যালাইন প্রয়োগের পূর্বে লক্ষ্য রাখতে হবে যে রোগীর উচ্চ রক্তচাপ আছে কি না।
- স্যালাইনের সাথে অথবা পৃথকভাবে নিম্নলিখিত এন্টিবায়োটিকসমূহ প্রয়োগ করা যেতে পারে। টেট্রাসাইক্লিন গ্রুপের এন্টিবায়োটিকসমূহই সাধারণত রোগীর অন্ত্রের কলেরার জীবাণু দূরীকরণে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এছাড়া সিগমামাইসিন, ট্রাইমিথোপ্রিম সালফামিথোক্সোল বা সিপ্রোফ্লক্সাসিন প্রভৃতি দ্বারা কলেরা রোগের চিকিৎসা করা যায়।
কলেরা রোগের প্রতিরোধ
কলেরা রোগের প্রতিরোধ করতে নিম্নলিখিত উপায় অবলম্বন করা যায়।
- পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যসম্মত বিষয়াদির উন্নয়ন ঘটাতে হবে। বিশেষ করে বিশুদ্ধ খাবার ও পানীয় জলের সুব্যবস্থা করতে হবে।
- শিক্ষা ব্যবস্থায় উন্নয়ন ঘটাতে হবে এবং গন সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।
- রোগীকে সুস্থ ব্যক্তি থেকে আলাদা রাখতে হবে।
- রোগীর যাবতীয় মল-মূত্র যথাযথভাবে শোধন করতে হবে।
- রোগীর দেখাশুনা-কারী এবং রোগের জীবাণু বাহক চিহ্নিত করে তাদের চিকিৎসা দিতে হবে।
- কোন কোন ক্ষেত্রে কেমোথেরাপি প্রদান করা যেতে পারে।
- শিশু বয়সে অথবা মহামারি দেখা দিলে টিকা প্রদান করাই উত্তম পন্থা।
লেখকের মন্তব্য : কলেরা রোগের লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধ বিস্তারিত জানুন
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে বর্তমানে বাংলাদেশসহ মোট ২৯টি দেশে কলেরা রোগী রয়েছে। যার মধ্যে সবচেয়ে আক্রান্ত রোগী রয়েছে আফগানিস্তানে। বাংলাদেশে প্রায় ১৪১ জন কলেরা রোগী রয়েছে। যেহেতু এই রোগ মানুষ থেকে মানুষে খুব সহজেই ছড়িয়ে যেতে পারে তাই আমাদের রোগী ও রোগের বাহক চিহ্নিত করে তাদের থেকে সাবধানে থাকতে হবে।
আরও পড়ুন হার্ট ব্লক দূর করার উপায়
প্রিয় পাঠক আমরা আজকে জানালাম কলেরা রোগের জীবাণুর নাম কি, কলেরা রোগ কিভাবে ছড়ায়, কলেরা রোগের লক্ষণ, কলেরা রোগ সনাক্তকরণ, কলেরা রোগের চিকিৎসা এবং কলেরা রোগের প্রতিরোধ করার উপায়।